অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পরও রাজধানীর গাবতলী, সায়েদাবাদ ও মহাখালী তিনটি বাস টার্মিনালে আগের মতোই নির্বিঘ্নে চলছে বেপরোয়া চাঁদাবাজি। বছরে কমপক্ষে ৩৬৩ কোটি টাকার বেশি অর্থ আদায় হয়। এই টার্মিনালগুলো রীতিমতো চাঁদাবাজির স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে।
দূরপাল্লার বাস থেকে মালিক সমিতি, শ্রমিক ইউনিয়ন, শ্রমিক ফেডারেশন, দুস্থ শ্রমিক পুনর্বাসন ও শ্রমিক কল্যাণের নামে মোটা অঙ্কের অর্থ আদায় করা হয়। এর পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক প্রভাব ও প্রশাসনের আশীর্বাদপুষ্ট কিছু বাস মালিক ও শ্রমিক নেতারা।
গত বছরের ৫ আগস্ট শ্রমিক-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের পর ক্ষমতার পরিবর্তন হলেও অপকর্মে প্রকাশ্যে হাত বদল হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে ‘পর্দার আড়াল’ থেকে কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করছেন নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের পলাতক নেতারা। তাদের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক রয়েছে একটি প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলের নেতাদের। পেছনের ১৫ বছরেও একই পদ্ধতিতে দুই দলের নেতারা নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া করে চাঁদার টাকা ভাগবাঁটোয়ারা করতেন। যুগান্তরের নিজস্ব অনুসন্ধান ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ থেকে এই চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে।
অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পরও রাজধানীর গাবতলী, সায়েদাবাদ ও মহাখালী তিনটি বাস টার্মিনালে আগের মতোই নির্বিঘ্নে চলছে বেপরোয়া চাঁদাবাজি। বছরে কমপক্ষে ৩৬৩ কোটি টাকার বেশি অর্থ আদায় হয়। টার্মিনালগুলো রীতিমতো চাঁদাবাজির স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে। তিনটি টার্মিনাল থেকে বছরে আদায় হওয়া অর্থের খণ্ডকাল-ভিত্তিক হিসাব অনুযায়ী, সায়েদাবাদ থেকে ২৩০ কোটি ৪০ লাখ, মহাখালী থেকে ৮৯ কোটি ৬৪ লাখ এবং গাবতলী থেকে ৪৩ কোটি ২০ লাখ টাকা উঠছে। তবে বাস্তবে এই অঙ্ক আরও বেশি হতে পারে বলে ধারণা সাধারণ বাস মালিকদের। তারা জানান, রীতিমতো জিম্মি করে কোনো রসিদ ছাড়াই চাঁদার টাকা আদায় করা হয়। তহবিলের সুনির্দিষ্ট হিসাব নেই এবং কত টাকা জমা আছে তা কেউ জানে না।
গত প্রায় ১০ মাস আগে ভুক্তভোগীরা প্রধান উপদেষ্টা ও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাসহ সরকারের সংশ্লিষ্টদের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। কিন্তু এখনও কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর দলবাজি, দখলবাজি ও চাঁদাবাজি নতুন করে শুরু হয়েছে। আগের মতোই চাঁদাবাজি রাজনীতিবিদদের চর্চা হয়ে গেছে। এসব চাঁদাবাজি থেকে বের হতে রাজনীতিবিদ ও সরকারের দায়িত্বশীল ভূমিকা প্রয়োজন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, গণ-অভ্যুত্থানের পর দেশে চাঁদাবাজি থাকবে না—এটাই মানুষের প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু বাস্তবে পরিবর্তন হয়নি। এসব স্থানে শুধু ব্যক্তির পরিবর্তন হয়েছে। চাঁদাবাজির লাগাম টানতে সরকারের উদ্যোগ নেওয়া দরকার ছিল। আইন প্রয়োগ করা উচিত ছিল। কিন্তু সরকার তা করতে পারেনি।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) যুগ্ম পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক-দক্ষিণ) মো. এনামুল হক বলেন, বাস টার্মিনালগুলোতে চাঁদাবাজি অনেকটাই ওপেন সিক্রেট। শ্রমিক কল্যাণ, শ্রমিক ও মালিক সমিতিসহ নানা নামে-বেনামে চাঁদা তোলা হয়। যারা সরাসরি ভুক্তভোগী, তারা সাধারণত মুখ খোলে না এবং অভিযোগও দেয় না। ট্রাফিক পুলিশের মাঠপর্যায় থেকে এসব চাঁদাবাজির ভাগ নেওয়া হয়—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যদি কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ আসে, অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ বিষয়ে উচ্চপর্যায় থেকে কঠোর নির্দেশনা রয়েছে।
সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল: ঢাকা-কুমিল্লা রুটে চলাচল করা বাসগুলোতে প্রতিদিন চাঁদাবাজি হচ্ছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, জাকির হোসেন (ছদ্মনাম) পরিচালিত চারটি বাসের প্রতিটির জন্য কমলাপুরে ৮৫০, টিকাটুলিতে ৬০০ ও কুমিল্লা শহরে ১৭৫০ টাকা চাঁদা দিতে হয়। রাজনীতিবিদ, ট্রাফিক পুলিশ, প্রশাসন, কাউন্টার ভাড়া, টিকিট খরচ, লাইনম্যান ও শ্রমিক কল্যাণের নামে এই অর্থ আদায় করা হয়।
চাঁদার টাকা কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করে ব্যানার মালিক, বিভিন্ন পরিবহণ মালিক সমিতি এবং শ্রমিক ফেডারেশন। এই ফেডারেশনের অধীনে সব শ্রমিক ইউনিয়নগুলো কার্যক্রম পরিচালনা করে। সায়েদাবাদ থেকে প্রতিদিন প্রায় ২০০০টি বাস বিভিন্ন রুটে চলাচল করে। বৃহত্তর কুমিল্লা অঞ্চলে এশিয়ান ট্রান্সপোর্টের ব্যানারে ৫০টি, এশিয়া লাইন ৬০, এশিয়া এয়ারকোন ৪০, তিশা প্লাস ৬৫, সুরমা সুপার ১২০, পাহাড়িকা ৩৫ ও পদ্মা পরিবহণের ৩৫টি বাস চলাচল করে। নোয়াখালী অঞ্চলে হিমাচল ব্যানারে ৩০টি, হিমালয় ৩৫, নিলাচল ৩০, একুশে ৩৫, ঢাকা এক্সপ্রেস ২০, ড্রিমল্যান্ড ২০ ও জোনাকি পরিবহণের ৫৫টি বাস চলাচল করে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পরিত্যক্ত বাস টার্মিনালে প্রতিদিন ৩০০-এর বেশি বাস পার্কিং করা হয়। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, সায়েদাবাদ টার্মিনালের ঢাকা মহানগর সড়ক পরিবহণ শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি এই পার্কিং নিয়ন্ত্রণ করেন। তারা অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের দাবি, প্রতিটি বাস থেকে দিনে ১০০ টাকা করে চাঁদা তোলা হয়। টার্মিনালে জায়গা না থাকায় বাসগুলো এখানে অস্থায়ীভাবে রাখা হয়। সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান ভান্ডারি বলেন, “আমি পার্কিং নিয়ন্ত্রণ করি না। এখানে কারা চাঁদাবাজি করে, তা নিয়ে পরিবহণ মালিক সমিতিকে জিজ্ঞেস করতে পারেন।”
ঢাকা সড়ক পরিবহণ মালিক সমিতির সভাপতি এমএ বাতেন বলেন, মালিকদের নিজস্ব ব্যানার, কাউন্টার, কর্মচারী ও লাইনম্যান রাখতে অতিরিক্ত খরচ হয়। তাই একই নামে একাধিক পরিবহণ চলাচল করলে অতিরিক্ত টাকা তোলা হয়। তবে কেউ অভিযোগ করলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি দাবি করেন, পরিবহণ থেকে চাঁদাবাজি ও নৈরাজ্য ঠেকাতে তারা কঠোর। নোয়াখালী অঞ্চলে ১৩টি কোম্পানির প্রায় ৪০০ বাস নিয়ন্ত্রণ করে বৃহত্তর নোয়াখালী শ্রমিক কমিটি। এই কমিটির নামে গাড়িগুলো থেকে দিনে ৭০ টাকা চাঁদা তোলা হয়। সাধারণ সম্পাদক কাজী লিটন এবং সভাপতি জলিলুর রহমান জলিল এই চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করেন। অভিযোগ আছে, লিটন ও জলিলের নেতৃত্বে ১৬ অক্টোবর টার্মিনাল শ্রমিক কমিটির অফিস দখল করা হয়। লিটন যুগান্তরকে বলেন, “গত বছরের ৫ আগস্টের আগে অল্প কিছু টাকা চাঁদা নেওয়া হতো, যা শ্রমিকদের কল্যাণে ব্যয় হতো। এখন এক টাকাও চাঁদা নেওয়া হয় না।”
সংগঠনগুলোও জানাচ্ছে, শুধু জাকির হোসেনের বাস নয়, সায়েদাবাদ টার্মিনালে দেশের বিভিন্ন রুটে চলাচল করা প্রায় ২ হাজার বাস থেকে প্রতিদিন প্রায় ৬৪ লাখ টাকা চাঁদা তোলা হয়। মাসে এভাবে ১৯ কোটি ২০ লাখ এবং বছরে ২৩০ কোটি ৪০ লাখ টাকা আদায় হয়।
মহাখালী বাস টার্মিনাল:
মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে প্রতিদিন উত্তর, পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলে ২৪০০ থেকে ২৬০০টি দূরপাল্লার বাস চলাচল করে। প্রতিটি বাস থেকে টার্মিনালের ভেতরে ২০০, সমিতির নামে ২০০, লাইনম্যানের নামে ২০০ এবং প্রধান সড়কে ওঠার জন্য ২০০ টাকা চাঁদা নেওয়া হয়। এর ফলে দিনে ২০ লাখ ৮০ হাজার টাকা, মাসে ৬ কোটি ২৪ লাখ এবং বছরে ৭৪ কোটি ৮৮ লাখ টাকা আদায় হয়।
টার্মিনালে ২০০-এর বেশি কাউন্টার রয়েছে। এসব কাউন্টার থেকে প্রতি মাসে ১২০০ থেকে ১৫০০ টাকা করে চাঁদা নেওয়া হয়, যা বছরে ৩৬ লাখ টাকা। এছাড়া কাউন্টার ছাড়া প্রায় ৫০০ বাসের প্রতিটি থেকে দিনে ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা চাঁদা নেওয়া হয়। ফলে দিনে ৪ লাখ, মাসে ১ কোটি ২০ লাখ এবং বছরে ১৪ কোটি ৪০ লাখ টাকা আদায় হয়। সব মিলিয়ে মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে বছরে ৮৯ কোটি ৬৪ লাখ টাকা চাঁদা উঠছে।
টার্মিনালে সামনে রাস্তায় চলাচলকারী দূরপাল্লার বাস থেকেও চাঁদা নেওয়া হয়। নতুন বাস অন্তর্ভুক্তিতেও চাঁদা ধার্য রয়েছে। এসব চাঁদা নিয়ন্ত্রণ করে ঢাকা সড়ক মালিক সমিতি, মহাখালী বাস টার্মিনাল মালিক সমিতি, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ শ্রমিক ফেডারেশন, ঢাকা জেলা বাস-মিনিবাস সড়ক পরিবহণ শ্রমিক ইউনিয়নের শীর্ষ নেতা এবং একটি প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলের দুই শীর্ষ নেতা।
খোঁজে জানা গেছে, মহাখালী বাস টার্মিনালে চাঁদাবাজি মূলত সাবেক সভাপতি সাদেকুর রহমান হিরুর নেতৃত্বে পরিচালিত হয়। আত্মগোপনে থাকা হিরুর চাঁদাবাজিতে সহযোগিতা করে মহাখালী বাস টার্মিনাল মালিক সমিতির একাধিক নেতা। তারা দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে হিরুর নেতৃত্বে টার্মিনালে দাপট ও চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করছে। হিরুর মোবাইলে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও ফোনটি বন্ধ পাওয়া গেছে।অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা, ডিএমপি ও শ্রম অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন দফতরে ভুক্তভোগীরা লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। কিন্তু এখনও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
এছাড়া, আওয়ামী সরকারের পতনের পর মহাখালীতে দলটির অনেক নেতার বাস এখন অন্যদের নিয়ন্ত্রণে আছে। বিশেষ করে এনা পরিবহণের অনেক বাস ইউনাইটেড পরিবহণের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। ১০০টি বাস যুক্ত হয়েছে স্টার লাইনে।
গাবতলী বাস টার্মিনাল:
গাবতলী বাস টার্মিনাল থেকে পাটুরিয়া ঘাট পর্যন্ত সেলফি পরিবহণের ৩০০টির বেশি বাস চলাচল করে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে প্রতিটি বাস থেকে প্রতিদিন ৭০০ টাকা চাঁদা নেওয়া হচ্ছে। এর ফলে দিনে ২ লাখ ১০ হাজার টাকা, মাসে ৬৩ লাখ এবং বছরে ৭ কোটি ৫৬ লাখ টাকা চাঁদা তোলা হচ্ছে।
শুধু সেলফি পরিবহণ নয়, গাবতলী থেকে প্রায় ৪০০ পরিবহণ ব্যানারে চলাচল করা ২ হাজারের বেশি বাস থেকেও প্রতিদিন ৪০০ থেকে ৬০০ টাকা চাঁদা নেওয়া হয়। এতে দিনে মোট ১২ লাখ টাকা, মাসে ৩ কোটি ৬০ লাখ এবং বছরে ৪৩ কোটি ২০ লাখ টাকা আদায় হয়।
আওয়ামী লীগ সরকারের সময় এসব চাঁদা নিয়ন্ত্রণ করতেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ শ্রমিক ফেডারেশনের সাবেক সভাপতি শাজাহান খান, সহসভাপতি মফিজুল হক বেবু, সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আব্বাস উদ্দিন, বাংলাদেশ বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক আবু রায়হান, সদস্য কাজী ফরিদুল হক হ্যাপি ও যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হোসেন খান নিখিল।
গত ৫ আগস্ট শাজাহান খান জেলে থাকায় এবং বাকিরা গা-ঢাকা দেওয়ায় টার্মিনালের নিয়ন্ত্রণ বদলেছে। এরপর থেকে টার্মিনাল নিয়ন্ত্রণ করছে একটি প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেতারা। তারা ইশারায় পুরো টার্মিনাল পরিচালনা করছে। তবে আগের তুলনায় চাঁদার পরিমাণ কমানো হয়েছে। সেলফি পরিবহণের একাধিক ড্রাইভার জানিয়েছেন, আগে যারা চাঁদা তুলত, তাদের এখন আর দেখা যায় না। নতুন কিছু মুখ এখন চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করছে। গাবতলী, আমিন বাজার, সাভার ও পাটুরিয়া ঘাটে এখনো প্রতিদিন বাসে চাঁদা দিতে হয়।

