একসময়ের কর্দমাক্ত সরকারি প্রকল্প, বাংলাদেশ হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষ (বিএইচটিপিএ) পরিচালিত ৩৫৫ একরের কালিয়াকৈর হাই-টেক পার্ক এখন দক্ষিণ এশিয়ার ইলেকট্রনিক্স, তথ্য প্রযুক্তি ও ডেটা অবকাঠামোর দ্রুত বর্ধনশীল কেন্দ্রের মধ্যে একটি।
গাজীপুরের উত্তর প্রান্তে অবস্থিত এই পার্ক দেশের নতুন শিল্প যুগ এবং প্রযুক্তিগত রূপান্তরের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে করছে। এখানে ব্যাপক বিনিয়োগ প্রবাহিত হচ্ছে, যা দেশের ডিজিটাল উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে নতুন মাত্রা দিচ্ছে। ১৯৯৯ সালের জুলাই মাসে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ বিনিয়োগ বোর্ডের সভায় পার্কটির ধারণা প্রথমবারের মতো আলোচিত হয়। পরিকল্পনার মূল উদ্দেশ্য ছিল একটি প্রযুক্তি-চালিত উৎপাদন ভিত্তি তৈরি করা, যা বাংলাদেশকে ডিজিটাল অর্থনীতির শীর্ষে পৌঁছাতে সাহায্য করবে। দুই দশকেরও বেশি সময়ের পর সেই স্বপ্ন বাস্তব রূপ নিয়েছে।
২০২৪ সালের আগস্টে রাজনৈতিক পরিস্থিতি পরিবর্তনের পর থেকে কালিয়াকৈর হাই-টেক পার্ক স্থানীয় ও বিদেশী ৫০টি সংস্থার কাছ থেকে নতুনভাবে ৬৪ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ প্রস্তাব পেয়েছে। এর ফলে পার্কের মোট বিনিয়োগ এখন ৮০০ মিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে। একসময়ের কর্দমাক্ত সরকারি প্রকল্প, বাংলাদেশ হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষ (বিএইচটিপিএ) পরিচালিত ৩৫৫ একরের কালিয়াকৈর হাই-টেক পার্ক এখন ইলেকট্রনিক্স, তথ্য প্রযুক্তি ও ডেটা অবকাঠামোর জন্য দক্ষিণ এশিয়ার দ্রুত বর্ধনশীল কেন্দ্রের মধ্যে একটি।
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব জানান, আরও তিনটি বিদেশী কোম্পানি পার্কে কারখানা স্থাপনে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। সরকার বর্তমানে তাদের প্রস্তাবগুলো বিবেচনা করছে। তিনি নাম প্রকাশ না করে বলেন, “আমরা সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে আলোচনার প্রাথমিক পর্যায়ে আছি।” ইতোমধ্যে ৩৪টি কোম্পানি তাদের কার্যক্রম শুরু করেছে, যেখানে ৩,০০০-এর বেশি লোক কর্মরত। বিএইচটিপিএ কর্মকর্তাদের মতে, পার্ক সম্পূর্ণ চালু হলে এই সংখ্যা ৫০,০০০ পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে। দক্ষ জনবল নিশ্চিত করতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় পার্কের ভেতরে একটি বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট গড়ে তুলছে।
সক্রিয় ফার্মগুলোর মধ্যে হুন্দাই ইতোমধ্যেই গাড়ি সংযোজন শুরু করেছে এবং শাওমি স্মার্টফোন উৎপাদন করছে। ওয়ালটন হাই-টেক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ১০০ মিলিয়ন ডলারের একটি কারখানা নির্মাণ করছে। দেশের প্রথম স্থানীয় বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্র্যান্ড ‘বাংলা কারস’ তাদের নিজস্ব ইভি প্ল্যান্ট তৈরি করছে। ড্যাফোডিল কম্পিউটারস কম্পিউটার যন্ত্রাংশ তৈরির জন্য একটি ইউনিট স্থাপন করেছে। এছাড়া একটি জাপানি ফার্ম ক্রেডিট ও ডেবিট কার্ড উৎপাদনের জন্য কারখানা তৈরি করছে। এর ফলে আমদানির ওপর নির্ভরতা কমবে। পার্কের ডিজিটাল কেন্দ্রবিন্দুতে বাংলাদেশ ডেটা সেন্টার কোম্পানি লিমিটেড এবং ফেলিসিটি আইডিসি গুরুত্বপূর্ণ ক্লাউড ও ডেটা স্টোরেজ কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
নির্মাণাধীন সবচেয়ে বড় প্রকল্পটি হলো ২০০ মিলিয়ন ডলারের একটি টিয়ার–৪ ডেটা সেন্টার। এটি তৈরি করছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ওসিরিস গ্রুপ এবং হংকংয়ের জাত্রা ইন্টারন্যাশনাল। এটি হবে বাংলাদেশে প্রথম এ ধরনের ডেটা সেন্টার। এর ফলে দেশের তথ্য স্থানীয়ভাবে ক্লাউডে সংরক্ষণ করা যাবে এবং ডেটা সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত হবে।
পূর্ণ সক্ষমতার পথে কালিয়াকৈর হাই-টেক পার্ক:
সাম্প্রতিক এক পরিদর্শনে কালিয়াকৈর হাই-টেক পার্কের রূপান্তর স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। অভ্যন্তরীণ সড়ক নেটওয়ার্ক সম্পূর্ণ হয়েছে এবং ছয়টি শিল্প ব্লকে এখন অ্যাসেম্বলি লাইন, ডেটা হাব এবং গবেষণা ও উন্নয়ন কেন্দ্র চালু আছে। তিনটি গভীর পাম্প স্টেশন ভূগর্ভস্থ পাইপলাইনের মাধ্যমে কারখানাগুলোতে পানি সরবরাহ করছে। দুটি সাবস্টেশন সক্রিয় রয়েছে, এবং নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে আরও একটি ২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণাধীন।
কালিয়াকৈর হাই-টেক পার্কের প্রকল্প পরিচালক রাকিবুল হাসান জানান, ৫০টি শিল্প প্লটই ইতোমধ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এর ফলে পার্ক তার পূর্ণ সক্ষমতার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। তিনি বলেন, “বর্তমানে ৩৪টি কোম্পানি কার্যক্রম চালাচ্ছে, যেখানে প্রায় ৩,০০০ কর্মী কর্মরত। আরও ১৪টি কারখানা নির্মাণাধীন রয়েছে, এবং ১৬টি কোম্পানি নির্মাণের অপেক্ষায় আছে। অধিকাংশ বিলম্ব হয়েছে বিদ্যুৎ অনুমোদন, নকশা ছাড়পত্র বা অর্থায়নের কারণে।”
নতুন বিনিয়োগকারীদের জন্য বর্তমানে খালি প্লট নেই। তবে সম্প্রতি চারটি নতুন সংস্থাকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, এবং তারা শীঘ্রই জমি পাবে। রাকিবুল হাসান জানান, “পরবর্তী সম্প্রসারণ সামিট টেকনোপলিস লিমিটেড এবং বাংলাদেশ টেকনোসিটি লিমিটেডের কাছ থেকে পুনরুদ্ধার করা প্লট থেকে হবে।” পার্কের প্রাথমিক পর্যায়ে সামিট ১,৬৫,০০০ বর্গফুটের সিগনেচার বিল্ডিং, ৬০,০০০ বর্গফুটের শিল্প ব্লক এবং বায়োটেক ও মোবাইল উৎপাদনের সুবিধা নির্মাণ করেছিল। বাংলাদেশ টেকনোসিটি ৩,১৩,০০০ বর্গফুটের আটতলা সোলারিস বিল্ডিংসহ শিল্প ও অফিসের জায়গা তৈরি করেছে।
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলেন, “আমরা পূর্বে ইজারা দেওয়া কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে কিছু অব্যবহৃত জমি পুনরুদ্ধারের কাজ করছি। একটি কোম্পানি ইতোমধ্যে তাদের জমির অংশ ফেরত দেওয়ার লিখিত আশ্বাস দিয়েছে। জমি উদ্ধার হলে আমরা আগ্রহ দেখানো আরও কারখানাকে জায়গা দিতে পারব।” তৈয়্যবের মতে, পার্কের ক্রমবর্ধমান ব্যস্ততা বাংলাদেশের ডিজিটাল শিল্পায়নে বেসরকারি খাতের আস্থার স্পষ্ট প্রতিফলন।
বিনিয়োগকারীদের ক্রমবর্ধমান ইকোসিস্টেম:
কালিয়াকৈর হাই-টেক পার্কে বর্তমানে ইলেকট্রনিক্স, তথ্য প্রযুক্তি এবং গবেষণা ও উন্নয়ন খাতে ৩৪টি সক্রিয় কোম্পানি কার্যক্রম চালাচ্ছে। ফেয়ার টেকনোলজি লিমিটেড উৎপাদন ও সম্প্রসারণে ১৫ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। লিও আইসিটি কেবলস লিমিটেড ৩.৮ মিলিয়ন ডলারের ব্যয়ে ফাইবার অপটিক কেবল প্ল্যান্ট পরিচালনা করছে। গোল্ডেন ইন্টারন্যাশনাল বিডি লিমিটেড ৩.৫৩ মিলিয়ন ডলারে কনজিউমার ইলেকট্রনিক্স উৎপাদন করছে এবং সোনার বাংলা ফাউন্ডেশন বিডি মেডিকেল ডিভাইসে ২ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে।
ইএটিএল ইনোভেশন হাব লিমিটেড ১০ মিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগে গবেষণা ও উদ্ভাবনে মনোনিবেশ করেছে। রেডডট ডিজিটাল লিমিটেড এবং ড্যাফোডিল কম্পিউটারস লিমিটেড যথাক্রমে ২.৬ মিলিয়ন ও ৩ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। চালু থাকা কোম্পানিগুলো ইতোমধ্যেই ৩০০ মিলিয়ন ডলারের বেশি বিনিয়োগ বাস্তবায়ন করেছে। এর ফলে পার্কটি একটি ধারণা থেকে পূর্ণাঙ্গ শিল্প ইকোসিস্টেমে রূপান্তরিত হয়েছে।
নির্মাণাধীন আরও কারখানার সঙ্গে যুক্ত ২৭০ মিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ রয়েছে। এর মধ্যে স্মার্ট হাই-টেক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ১২ মিলিয়ন ডলার, এএলইউ হাই-টেক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের (একজন বিদেশী বিনিয়োগকারী) ১০০ মিলিয়ন ডলার এবং এক্সপোর্ট কম্পিটিটিভনেস ফর জবস (ইসিফরজে) প্রকল্পের ১১৮ মিলিয়ন ডলার অন্তর্ভুক্ত।
পরিকল্পিত বিনিয়োগের আরও ২৭০ মিলিয়ন ডলার নকশা পর্যায়ে রয়েছে। ওয়ালটন হাই-টেক ইন্ডাস্ট্রিজ, গ্লোবাল ব্র্যান্ড প্রাইভেট লিমিটেড এবং দক্ষিণ কোরিয়ার কোনা সফটওয়্যার ল্যাব লিমিটেড তাদের প্রকল্পের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করছে। ভূমি উন্নয়নের প্রাথমিক পর্যায়ের প্রকল্পগুলো, যার মধ্যে এ টু জেড ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস এবং বাংলা কারস রয়েছে, অতিরিক্ত ২৫–৩০ মিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগের প্রতিনিধিত্ব করে।
বিদ্যুৎ ও নীতিগত প্রতিবন্ধকতা:
অগ্রগতি সত্ত্বেও, কালিয়াকৈর হাই-টেক পার্ক ক্রমবর্ধমান চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে। বিদ্যুতের চাহিদা ৪০ মেগাওয়াট ছাড়িয়ে যেতে পারে, যেখানে কিছু কারখানার জন্য প্রতিটি ৫ মেগাওয়াট পর্যন্ত বিদ্যুৎ প্রয়োজন। নীতিগত প্রতিবন্ধকতাও আছে। বিনিয়োগকারীরা শুল্ক বিলম্ব এবং কাঁচামালের ওপর উচ্চ আমদানি শুল্ক নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। ড্যাফোডিল কম্পিউটারস, বিডি সফটওয়্যার অ্যান্ড সিকিউরিটি সিস্টেমস, এএলইউ হাই-টেক এবং হোয়াইটশেল লিমিটেড জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) আহ্বান জানিয়েছে, যেন ভিয়েতনাম ও মালয়েশিয়ার মতো আঞ্চলিক প্রতিযোগীদের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কর কাঠামো এবং বন্ডেড ওয়্যারহাউস নীতি আধুনিক করা হয়।
নীতিগত প্রতিবন্ধকতার কথা স্বীকার করে ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলেন, পার্ক কর্তৃপক্ষ শুল্কনীতি-সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানের জন্য এনবিআরকে চিঠি দিয়েছে। এতে এইচএস কোড পুনঃনির্ধারণও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, যাতে বিনিয়োগকারীরা সরঞ্জাম ঝামেলা ছাড়াই আমদানি করতে পারে। তিনি আরো বলেন, “আমরা বাংলাদেশে ভালো করছে এমন প্রযুক্তি শিল্প, যেমন ব্যাটারি উৎপাদন, ক্লাউড প্রসেসিং, জিপিইউ, সেমিকন্ডাক্টর ডিজাইন এবং এআইকে সমর্থন করার চেষ্টা করছি। আমরা এনবিআরকে উদীয়মান প্রযুক্তিগুলোর জন্য করনীতি সহজ করার আহ্বান জানিয়েছি, যাতে তারা বিকশিত হতে পারে।” তিনি আরও যোগ করে বলেন, “আমরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। যদি আমরা এই ট্রেনটি ধরতে না পারি, তবে পিছিয়ে পড়ব।”
কালিয়াকৈরের অগ্রগতি বাংলাদেশের ১১৮ মিলিয়ন ডলারের ‘এক্সপোর্ট কম্পিটিটিভনেস ফর জবস’ উদ্যোগের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, যা উচ্চ-দক্ষতার ডিজিটাল কর্মসংস্থান তৈরিতে সহায়ক। আইটি হাব ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড (বাংলাদেশ-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) এবং কোনা সফটওয়্যার ল্যাব লিমিটেড (দক্ষিণ কোরিয়া)সহ বিদেশী অংশীদারদের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগ রপ্তানিমুখী গবেষণা ও উন্নয়ন ভিত্তি তৈরিতে সহায়তা করছে।
শিল্প বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পার্কটি একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ইকোসিস্টেমে পরিণত হচ্ছে, যা আমদানিকৃত ইলেকট্রনিক্স এবং বিদেশী ডেটা স্টোরেজের ওপর বাংলাদেশের নির্ভরতা উল্লেখযোগ্যভাবে কমাতে পারে। সম্পূর্ণ চালু হলে এটি প্রযুক্তি রপ্তানি এবং ডিজিটাল পরিষেবার প্রধান উৎস হিসেবে আবির্ভূত হবে। ফেলিসিটি আইডিসি ডেটা সেন্টারের ম্যানেজার হিমন মজুমদার বলেন, “আমাদের সম্ভাবনা আছে। এখন আমাদের স্বনির্ভর হতে নিজস্ব প্রযুক্তি শিল্পের বিকাশে মনোযোগ দিতে হবে।” শিল্প বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করেছেন, পার্কটি শুধু হার্ডওয়্যার তৈরি করছে না, এটি একটি নতুন ধরনের অর্থনীতিও তৈরি করছে।

