জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সরকারি তহবিলের আওতায় নেওয়া প্রকল্পগুলোতে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান জানিয়েছেন, এসব প্রকল্পে ৫০ শতাংশেরও বেশি ক্ষতির সঙ্গে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে।
তিনি বলেন, “জলবায়ু তহবিল এখন রাজনৈতিক যোগসাজশে দুর্নীতির বিশেষায়িত ক্ষেত্র হিসেবে দাঁড়িয়েছে।” বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ ট্রাস্ট (বিসিসিটি) বোর্ডের সদস্যসহ রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী মহলের স্বার্থের দ্বন্দ্ব, ক্ষমতার অপব্যবহার, কর্মকর্তাদের দুর্নীতি এবং ঠিকাদারদের অবৈধ লেনদেনে এ খাতে দুর্নীতি নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে তহবিল থেকে ২ হাজার কোটি টাকারও বেশি অর্থ আত্মসাৎ হয়েছে বলে জানান তিনি।
গতকাল (বুধবার) রাজধানীর ধানমন্ডির মাইডাস সেন্টারে টিআইবি কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য তুলে ধরেন ড. ইফতেখারুজ্জামান। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন টিআইবির উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের, গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মুহাম্মদ বদিউজ্জামান এবং আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম। ‘বাংলাদেশে জলবায়ু অর্থায়নে সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন সিনিয়র রিসার্চ ফেলো মো. মাহ্ফুজুল হক ও রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট মো. সহিদুল ইসলাম।
ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “জলবায়ু অর্থায়নে ঝুঁকি ও বিপদাপন্নতা বিবেচনায় প্রাধান্যনির্ভর কার্যক্রম বাস্তবায়নের সুযোগ থাকলেও অনিয়মের কারণে তা সম্ভব হয়নি।” তিনি উল্লেখ করেন, বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর একটি। উন্নত দেশগুলো বছরে ১০০ বিলিয়ন ডলার করে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে অনুদান দেওয়ার অঙ্গীকার করেছিল। কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি এখনো পূরণ হয়নি। আন্তর্জাতিক তহবিল থেকেও বরাদ্দ পাওয়া গেছে খুবই অল্প পরিমাণে। ফলে জাতীয় বাজেট থেকেই জনগণের অর্থে গঠিত জলবায়ু তহবিল ব্যবহারে সুশাসন নিশ্চিত করা জরুরি, অথচ সরকারি অর্থায়নে সুশাসনের সব মানদণ্ডেই ঘাটতি রয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
টিআইবি পরিচালক আরও বলেন, ২০০৩ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত জলবায়ু প্রকল্পে বাংলাদেশের প্রয়োজন ছিল ১০ থেকে ১২ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বরাদ্দ মিলেছে মাত্র ১.২ বিলিয়ন ডলার। এই অল্প অর্থও স্বচ্ছতার সঙ্গে ব্যয় হয়নি; বরং প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার বেশি আত্মসাৎ বা অপচয় হয়েছে, যা সরকারি বরাদ্দের প্রায় ৫৪ শতাংশ।
টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বিসিসিটি ফান্ড থেকে ৪৫৮ দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ অনুমোদন দেওয়া হয়। এর মধ্যে ২৪৮ দশমিক ৪ মিলিয়ন ডলার, অর্থাৎ প্রায় ২ হাজার ১১০ কোটি ৬০ লাখ টাকা দুর্নীতিতে নষ্ট হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, এসব প্রকল্প অনুমোদনে ‘রাজনৈতিক বিবেচনা, যোগসাজশ ও স্বজনপ্রীতির’ প্রবণতা স্পষ্ট। অথচ তহবিল ব্যবস্থাপক সংস্থার কর্মকর্তারা অনিয়ম রোধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেননি।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, জলবায়ু অভিঘাত মোকাবিলায় প্রতি বছর ১২ হাজার ৫০০ মিলিয়ন ডলার প্রয়োজন হলেও ২০১৫ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত গড়ে বরাদ্দ মিলেছে মাত্র ৮৬ দশমিক ২ মিলিয়ন ডলার, যা প্রয়োজনের মাত্র ০.৭ শতাংশ। ২০২৪ সাল পর্যন্ত ৫৮৫টি প্রকল্পের মধ্যে মাত্র ৯০টির সংক্ষিপ্ত মূল্যায়ন সম্পন্ন হয়েছে। বাকি ৪৯৫টি প্রকল্পের প্রভাব এখনো যাচাই করা হয়নি।

