দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম নতুন বাণিজ্যিক লক্ষ্য অর্জনের পথে এগোচ্ছে। প্রতিদিনের জাহাজ চলাচল, কনটেইনার হ্যান্ডলিং এবং ক্রেন কার্যক্রম দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখছে। বর্তমানে বন্দরে বছরে ৩৩ লাখ টিইইউ (২০-ফুট সমতুল্য ইউনিট) কনটেইনার হ্যান্ডলিং করা হচ্ছে। তবে ২০৪০ সালের মধ্যে এই সক্ষমতা প্রায় চার গুণ বাড়িয়ে ১ কোটি ৭ লাখ টিইইউতে পৌঁছানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
এই উদ্যোগ শুধু বন্দরের সম্প্রসারণ নয়; এটি বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ার বাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবে নতুন অবস্থানে নিয়ে যাবে। লক্ষ্যপথে পৌঁছাতে এখন জোর দেওয়া হচ্ছে অবকাঠামোগত সমন্বয়ে। মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল থেকে টেকনাফ পর্যন্ত সড়ক ও রেল সংযোগ আধুনিক ও সমন্বিত করার জন্য চট্টগ্রাম বন্দর সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় এবং রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতা চেয়েছে। কারণ আগামী দুই দশকে কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের চাপ বর্তমানের তুলনায় বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে।
সম্প্রতি বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরীর সভাপতিত্বে আয়োজিত উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে বন্দরের ভবিষ্যৎ রোডম্যাপ উপস্থাপন করা হয়। বৈঠকে ২০২৫ থেকে ২০৪০ সাল পর্যন্ত কনটেইনার হ্যান্ডলিং সক্ষমতা বৃদ্ধির ধাপভিত্তিক পরিকল্পনা এবং স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি সুপারিশের প্রস্তাব আনা হয়। পরে বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক স্বাক্ষরিত প্রতিবেদন নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের কাছে পাঠানো হয়। বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া এখন সরকারের নজরে রাখা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনালে বছরে ১৩ লাখ এবং জেনারেল কার্গো বার্থে ২০ লাখ কনটেইনার হ্যান্ডলিং হচ্ছে। সব মিলিয়ে বন্দরের সক্ষমতা ৩৩ লাখ টিইইউ। ২০৩০ সালের মধ্যে মোট সক্ষমতা ৪০ লাখ টিইইউতে উন্নীত হবে। এর মধ্যে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর ৮ লাখ, বে টার্মিনাল সিটি-১ ১৮ লাখ, পতেঙ্গা টার্মিনাল ৫ লাখ এবং লালদিয়া টার্মিনাল ৯ লাখ টিইইউ হারে কনটেইনার হ্যান্ডলিং সক্ষমতা বাড়াবে।
চলমান প্রকল্পের পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০৩০-২০৩৫ সালের মধ্যে বে টার্মিনাল সিটি-২ তৈরি হবে। এতে ১৮ লাখ টিইইউ হ্যান্ডলিং সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। ২০৩৫-২০৪০ সালের মধ্যে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর চালু হলে আরও ১৬ লাখ টিইইউ হ্যান্ডলিং সক্ষমতা তৈরি হবে। সব মিলিয়ে ২০৪০ সালে চট্টগ্রাম বন্দরের মোট সক্ষমতা ১ কোটি ৭ লাখ টিইইউতে পৌঁছাবে, যা বর্তমান সক্ষমতার প্রায় চার গুণ।
বন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এই লক্ষ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে একাধিক অবকাঠামো প্রকল্প বাস্তবায়নের চেষ্টা চলছে। লালদিয়া টার্মিনাল নির্মাণ চুক্তির পর্যায়ে, বে টার্মিনাল দ্রুত এগোচ্ছে এবং মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর প্রায় শেষের পথে। জাইকার সহায়তায় চলমান ‘বাংলাদেশ ন্যাশনাল পোর্ট স্ট্র্যাটেজি’ প্রকল্পের বেসলাইন রিপোর্টেও ২০৪০ সালের জন্য ১০.৭ মিলিয়ন টিইইউ হ্যান্ডলিং লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রম ঘিরে তিনটি মন্ত্রণালয় (নৌ, সড়ক ও রেল) সমন্বিত উদ্যোগের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলের পণ্য রপ্তানির জন্য বে টার্মিনাল ও কর্ণফুলী টানেল হয়ে টেকনাফ পর্যন্ত সংযোগ সড়ক নির্মাণের প্রকল্প ইতিমধ্যেই পরিকল্পনায় আছে।
বাংলাদেশ রেলওয়ে বর্তমানে ছয় রুটে তিন জোড়া ট্রেনে কনটেইনার পরিবহন করছে। বিদ্যমান অবকাঠামো ব্যবহার করে এটিকে আট রুটে সম্প্রসারণের লক্ষ্যও নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে মাতারবাড়ী টার্মিনালের দ্বিতীয় পর্যায় চালু হলে ফাসিয়াখালী সংযোগ সড়ক ও রেলট্র্যাকের ওপর চাপ বাড়বে, যা আগেভাগে সমন্বয় করা জরুরি।
চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব মো. ওমর ফারুক বলেন, ‘বর্তমানে পতেঙ্গা টার্মিনাল পূর্ণ সক্ষমতায় কাজ করছে। বে টার্মিনালের কাজ এগোচ্ছে, মাতারবাড়ী দ্রুত বাস্তবায়িত হচ্ছে। সবকিছু পরিকল্পনামাফিক চললে ২০৪০ সালের মধ্যে আমরা ১ কোটি ৭ লাখ টিইইউ হ্যান্ডলিং সক্ষমতায় পৌঁছাব।’
বন্দর উন্নয়ন পরিকল্পনা ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক গতিশীলতার জন্য স্বস্তিজনক বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা। চট্টগ্রাম পোর্ট ইউজার্স ফোরামের সভাপতি আমির হুমায়ুন চৌধুরী বলেন, ‘বন্দরের উন্নয়ন ইতিবাচক। তবে প্রকল্পগুলো যেন জনগণকে অন্ধকারে রেখে না হয় এবং বিদেশিদের হাতে না চলে যায়। সব কাজ ওপেন টেন্ডারের মাধ্যমে করা উচিত।’

