সাভারের চামড়া শিল্পনগরীকে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) থেকে বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষের (বেপজা) অধীনে নেওয়ার রোডম্যাপ তৈরি করতে কাজ করছে একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি।
শিল্প মন্ত্রণালয়ে কমিটির সুপারিশ এক মাসের মধ্যে জমা দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।
বৃহস্পতিবার (৬ নভেম্বর) ঢাকার আগারগাঁওয়ে বিডার প্রধান কার্যালয়ে এ বিষয়ে বৈঠক হয়। কমিটির সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। সভায় মূলত আলোচিত হয় কিভাবে শিল্পনগরীটি বেপজার নিয়ন্ত্রণে আনা যায়।
কমিটির সদস্যরা বলেন, বিনিয়োগ কাঠামো একীভূত করা, পরিবেশগত মান নিয়ন্ত্রণ জোরদার করা এবং প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করাই এই পদক্ষেপের মূল লক্ষ্য। ঢাকার পাশাপাশি কুমিল্লা ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন জোনে বেপজা সেন্ট্রাল এফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট (সিইটিপি) ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে ইতিবাচক ফলাফল দেখিয়েছে। হস্তান্তরের লক্ষ্য হলো সমন্বয়হীনতা দূর করা, পরিবেশগত ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করা এবং রপ্তানিতে প্রতিযোগিতামূলক সক্ষমতা বৃদ্ধি করা।
কমিটির প্রধান ও বেপজার নির্বাহী সদস্য মেজর জেনারেল (অব.) মো. নজরুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, “একটি সম্ভাব্যতা সমীক্ষা কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি বিস্তৃতভাবে সাভারের ট্যানারি শিল্পনগরীকে বেপজার অধীনে নেওয়ার সুবিধা ও অসুবিধি তুলে ধরবে। নিয়মকানুন, প্রশাসন, অপারেশন ও অর্থনৈতিক দিকগুলো আমরা বিস্তারিতভাবে পর্যালোচনা করব।”
তিনি আরও বলেন, “কমিটির প্রতিবেদন শিল্প মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। এরপর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে কোন মন্ত্রণালয়ের অধীনে স্থানান্তর করা হবে। সরকার ইতিমধ্যে বেপজাকে এই দায়িত্ব দেওয়ার ব্যাপারে ইতিবাচক। কার্যকরভাবে এটি বাস্তবায়িত হলে চামড়া খাতের পুনরুজ্জীবন সম্ভব।”
নজরুল ইসলাম জানান, এটি তাদের পঞ্চম বৈঠক। “আমরা কাজ অনেক এগিয়ে নিয়ে এসেছি। চলতি মাসেই সুপারিশ জমা দেব। কমিটিতে বিসিক, বেপজা, ব্যবসায়ী প্রতিনিধি সহ সব স্টেকহোল্ডার আছেন।”
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) একটি গবেষণায় দেখা গেছে, সাভার শিল্পনগরীতে কার্যকর সিইটিপি না থাকায় চামড়া ও পাদুকা প্রস্তুতকারকরা প্রায়ই স্থানীয় কাঁচামাল ব্যবহার করেন না। ফলে বাংলাদেশ সম্পূর্ণ রপ্তানি সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পারছে না। উল্টো, বিদেশ থেকে কাঁচামাল আমদানিতে ব্যাপক বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হচ্ছে।
দুই মাস আগে শিল্পনগরীকে বিসিক থেকে বেপজায় হস্তান্তরের রোডম্যাপ চূড়ান্ত করতে শিল্প মন্ত্রণালয়ে ফলো-আপ বৈঠক হয়। সভায় চামড়া রপ্তানি বাড়াতে প্রয়োজনীয় লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপ (এলডব্লিউজি) সনদের জন্য সিইটিপি দক্ষতার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী বলেন, “রপ্তানিকারকদের ও জাতীয় স্বার্থ বিবেচনা করে, সিইটিপি পরিচালনায় সর্বোচ্চ সক্ষম সংস্থার দায়িত্ব থাকা উচিত।”
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যমতে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের চামড়া খাতের রপ্তানি ১,১৪৫.০৭ মিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। ফরচুন বিজনেস ইনসাইটসের মতে, ২০২২ সালে বৈশ্বিক চামড়াজাত পণ্যের বাজার ৪৪০.৬৪ বিলিয়ন ডলার ছিল। ২০৩০ সালে এটি ৭৩৮.৬১ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
শিল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সমন্বিত নীতি সহায়তা থাকলে ২০৩০ সালের মধ্যে চামড়া খাত বছরে ৫ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি অর্জন করতে পারবে।
২০০৩ সালে শিল্প মন্ত্রণালয় বিসিকের মাধ্যমে সাভারে বৈজ্ঞানিকভাবে পরিচালিত ট্যানারি শিল্পনগরী গড়ার প্রকল্প হাতে নেয়। এর আওতায় পয়ঃনিষ্কাশন শোধনাগার (এসটিপি), কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার (সিইটিপি) ও ডাম্পিং ইয়ার্ড নির্মাণের কথা ছিল। প্রকল্পটি ২০০৫ সালের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও মেয়াদ ১২ বার বাড়ানো হয়। ব্যয় ১৭৫ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ১০১৫ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। ২০২১ সালে প্রকল্প আনুষ্ঠানিকভাবে সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়।
তবুও পরিবেশ দূষণ বন্ধে কমন ক্রোম রিকভারি ইউনিট পুরোপুরি নির্মিত হয়নি। কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কারণে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্রও মেলেনি। ফলে এলডব্লিউজি সনদও পাওয়া যাচ্ছে না।
বিডার ২০২৩ সালের গবেষণা অনুযায়ী, স্থানীয় ট্যানারি প্রতিষ্ঠানগুলো পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ও এলডব্লিউজি সনদ না থাকায় বিদেশি কাঁচামাল ব্যবহার করছে।
শিল্পনগরীতে বরাদ্দ ১৬২টি ট্যানারির মধ্যে ১৪০টি চালু আছে। তারা ওয়েট ব্লু, ক্রাস্ট ও ফিনিশড লেদার উৎপাদন করছে। সনদ না থাকায় ট্যানারিগুলো ইউরোপ-আমেরিকায় রপ্তানি করতে পারছে না। আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের কাছে বিক্রি না হওয়ায় তারা চীন ও অন্যান্য দেশে ৫০-৬০ শতাংশ কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে।
এলডব্লিউজির ওয়েবসাইট অনুযায়ী, দেশের মাত্র আটটি কোম্পানি সনদ পেয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে অ্যাপেক্স ফুটওয়্যার, এবিসি লেদার, রিফ লেদার, এসএএফ ইন্ডাস্ট্রিজ, পাইওনিয়ার সাইমন ট্যানিং বিডি লিমিটেড, সুপারএক্স লেদার লিমিটেড, সং শিন লেদার (বিডি) কোং লিমিটেড এবং অস্টিন লিমিটেড।

