ক্যান্সার সাপোর্টিভ কেয়ারের একটি অত্যাবশ্যকীয় ওষুধ পেগফিলগ্রাস্টিমের দাম আগে ছিল ৪০ হাজার টাকার বেশি। এখন এটি কোম্পানিভেদে পাওয়া যাচ্ছে ৪ হাজার, ১৮ হাজার ও ২০ হাজার টাকায়।
১৫ বছর আগে ক্যান্সার রোগীদের চিকিৎসার জন্য প্রায় পুরোপুরি বিদেশি ওষুধের ওপর নির্ভর করতে হতো। ফলে বছরে এক হাজার কোটি টাকারও বেশি খরচ হতো। অনেক রোগীর পক্ষে এত ব্যয় বহন করা সম্ভব ছিল না। তবে চিত্র বদলেছে। দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ক্যান্সারের ওষুধ উৎপাদনে এগিয়ে এসেছে। বর্তমানে দেশের প্রায় ৯৫ শতাংশ ক্যান্সারের ওষুধই দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো উৎপাদন করছে। এর ফলে ওষুধের দাম কমেছে এবং আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল রোগীরাও সাশ্রয়ী চিকিৎসা পাচ্ছেন।
সরকার এসব ওষুধ উৎপাদন ও কাঁচামাল আমদানিতে কর ও শুল্ক মওকুফ করেছে। ফলে প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর খরচও উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। বর্তমানে বীকন ফার্মাসিউটিক্যালস, ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস, রেনেটা পিএলসি, হেলথ কেয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসসহ ১৭ থেকে ১৮টি প্রতিষ্ঠান ক্যান্সারের ওষুধ উৎপাদন করছে।
বীকন ফার্মাসিউটিক্যালসের বায়োটেক ও পেলিয়াটিভ কেয়ারের এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম মাহমুদুল হক পল্লব বলেন, “দেশে এখন প্রায় সব ধরনের ক্যান্সারের ওষুধ উৎপাদন হচ্ছে। ২০০৯ সালে প্রথম ক্যান্সারের ওষুধ উৎপাদন শুরু করে বীকন ফার্মা। এখন আমাদের ১০০টিরও বেশি মলিকিউল রয়েছে। সক্ষমতা বিচারে আমরা একাই দেশের ক্যান্সারের ওষুধের প্রায় ৯০ শতাংশ উৎপাদন করতে সক্ষম।” তিনি আরও জানান, “দেশের চাহিদা পূরণ করে আমরা শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও মিয়ানমারসহ কয়েকটি দেশে ক্যান্সারের ওষুধ রপ্তানি করছি।”
দেশে উৎপাদন কমিয়েছে ক্যান্সারের ওষুধের দাম:
দেশে ক্যান্সারের ওষুধ উৎপাদনের ফলে রোগীরা আগের চেয়ে কম দামে ওষুধ পাচ্ছেন। ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালসের জেনারেল ম্যানেজার মোহাম্মাদ মিজানুর রহমান বলেন, “দেশে উৎপাদন বাড়ায় ক্যান্সারের ওষুধের দাম উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। এতে একদিকে আমদানি খরচ কমছে, অন্যদিকে নিম্ন আয়ের রোগীরাও সহজে চিকিৎসা পাচ্ছে।”
লাং ক্যান্সারের ‘এরলোনিক্স’ নামের একটি ওষুধ আগে আমদানি করা হতো। তখন প্রতি ইউনিটের দাম পড়ত সাড়ে ৭ হাজার টাকা। এখন এটি বিক্রি হচ্ছে মাত্র সাড়ে ৭০০ টাকায়। ক্যান্সার সাপোর্টিভ কেয়ারের একটি গুরুত্বপূর্ণ ওষুধ পেগফিলগ্রাস্টিমের দাম আগে ছিল ৪০ হাজার টাকার বেশি। এখন কোম্পানিভেদে এটি পাওয়া যাচ্ছে ৪ হাজার, ১৮ হাজার ও ২০ হাজার টাকায়। ফিলগ্রাস্টিম নামের আরেকটি ওষুধ আগে ৬০ হাজার টাকায় বিক্রি হতো। স্থানীয়ভাবে সক্রিয় উপাদান তৈরির পর ইনসেপ্টা এখন এটি ৪ হাজার টাকায় বিক্রি করছে। এই পরিবর্তনকে বিশেষ একটি মাইলফলক হিসেবে দেখা হচ্ছে। এতে কেবল রোগীর খরচ কমেনি, আমদানির ওপর নির্ভরতাও কমেছে। মিজানুর রহমান বলেন, “এপিআই ও বায়োসিমিলার তৈরি করা সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল। আমরা আশা করি সরকার এই ক্ষেত্রে প্রণোদনা বাড়াবে।”
নকল ওষুধ রোধে সরাসরি সরবরাহ:
ওষুধের গুণগত মান ও যথার্থতা নিশ্চিত করতে অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের উৎপাদিত ক্যান্সারের ওষুধ খুচরা বিক্রেতাদের বাদ দিয়ে সরাসরি হাসপাতাল, ফার্মেসি বা রোগীর কাছে পৌঁছে দিচ্ছে। বীকন ফার্মাসিউটিক্যালসের মাহমুদুল হাসান পল্লব বলেন, “আমাদের নিজস্ব কোল্ড-চেইন ডিস্ট্রিবিউশন নেটওয়ার্ক আছে। এর মাধ্যমে ওষুধ সরাসরি রোগীর কাছে পৌঁছায়। এতে নকল বা ভেজাল ওষুধের আশঙ্কা থাকে না এবং রোগীরা পায় আসল ওষুধ সঠিক দামে।”
সরকারও ক্যান্সারের ওষুধের উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ভ্যাট অব্যাহতি দিয়েছে এবং কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতির ওপর আমদানি শুল্ক মওকুফ করেছে। চলতি বছরের মার্চে ক্যান্সারের ওষুধ তৈরিতে ব্যবহৃত কাঁচামাল আমদানির ওপর উৎসে কর ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২ শতাংশ করা হয়েছে। সরকারের এই সুবিধাগুলো দেশব্যাপী ক্যান্সারের ওষুধকে আরও সহজলভ্য করেছে। প্রস্তুতকারকরা জানিয়েছেন, মাসে ক্যান্সারের ওষুধ বিক্রির পরিমাণ প্রায় ৫০-৫৫ কোটি টাকা। যদি এসব ওষুধ আমদানি করতে হতো, তাহলে বছরে খরচ হতো ১ হাজার কোটি টাকারও বেশি।
বাড়ছে ক্যান্সার আক্রান্ত সংখ্যা:
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, বাংলাদেশে বছরে ১ লাখ ৬৭ হাজার ২৫৬ জন ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছেন। এর মধ্যে পুরুষ রোগীই বেশি। প্রতি বছর ক্যান্সারে মারা যাচ্ছেন ১ লাখ ১৬ হাজার ৫৯৮ জন। এই পরিস্থিতি ক্যান্সারের ওষুধ উৎপাদনে প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিনিয়োগে উৎসাহী করেছে।
রেনেটা পিএলসির প্রধান নির্বাহী ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ কায়সার বলেন, “১০ বছর আগেও দেশে ক্যান্সারের প্রবণতা এত বেশি ছিল না। এখন দিন দিন এটি আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। তাই ওষুধ কোম্পানিগুলো এখানে বিনিয়োগ করছে, যাতে মানুষ কম খরচে ক্যান্সার প্রতিরোধী ওষুধ পায়।” তিনি আরও বলেন, “আমাদের দুটি ফ্যাক্টরি আছে—একটি সলিড ওরাল ওষুধের জন্য, আরেকটি ইনজেক্টেবল ওষুধের জন্য। এখনো ফ্যাক্টরি দুটি ব্রেক ইভেন পয়েন্টে পৌঁছায়নি। এগুলো ভবিষ্যতের জন্য তৈরি করা হয়েছে।”
দেশের চাহিদা পূরণের পর ক্যান্সারের ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো এখন দেশের বাইরে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে রপ্তানির দিকে নজর দিচ্ছে। ওয়ান ফার্মা বগুড়ায় ক্যান্সারের বায়োসিমিলার ড্রাগ উৎপাদনের জন্য প্ল্যান্ট স্থাপন করেছে।
ওয়ান ফার্মার প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক কে এস এম মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া ১০টি ওষুধের ৯টিই বায়োসিমিলার। তাই আমরা বায়োসিমিলার ওষুধ উৎপাদনে বিনিয়োগ করছি।” তিনি আরও বলেন, “ক্যান্সারের ইনজেক্টেবল ড্রাগ উৎপাদন শুরু করলে সেগুলো দেশের চাহিদা পূরণ করবে এবং আমরা রপ্তানিও শুরু করব। আফগানিস্তান, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমারসহ কয়েকটি দেশ ইতিমধ্যেই আমাদের সঙ্গে চুক্তি করেছে। উৎপাদন পুরোপুরি শুরু হলে এই দেশগুলো ওয়ান ফার্মার পণ্য ক্রয় করবে।”
এসিআই ফার্মাসিউটিক্যালসও নিজস্ব বায়োসিমিলার উৎপাদন ইউনিট তৈরি করছে। এসিআই ফার্মার জেনারেল ম্যানেজার মো. মাজহারুল ইসলাম বলেন, “আমাদের কারখানা আধুনিক প্রযুক্তিতে সুসজ্জিত। আমরা শুধু দেশীয় নয়, আন্তর্জাতিক বাজারেও ওষুধ সরবরাহ করতে চাই।”
বায়োসিমিলার ও ইমিউনোথেরাপিতে গুরুত্ব দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলো:
মাহমুদুল হাসান পল্লব বলেন, “ভবিষ্যতের ক্যান্সার চিকিৎসা হলো ইমিউনোথেরাপি। এসব আধুনিক ওষুধ উৎপাদনের জন্য আমরা ইতিমধ্যে বায়োটেক ও বায়োসিমিলার ফ্যাসিলিটি তৈরি করছি। বীকন বর্তমানে এই নতুন উৎপাদন ইউনিটের কাজ এগিয়ে নিচ্ছে। চালু হলে বাংলাদেশে আধুনিক ক্যান্সার চিকিৎসার নতুন দ্বার উন্মোচিত হবে।” গবেষণা ও এপিআই উৎপাদনে জোর দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশ মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল অনকোলজি বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ডা. সৈয়দ আকরাম হোসেন বলেন, “আমরা ক্যান্সার চিকিৎসায় দেশীয় ওষুধ ব্যবহার করছি। মান ভালো। তবে এই ওষুধগুলোর লোকাল ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল হওয়া দরকার।” তিনি আরও বলেন, “দেশে ক্যান্সারের ওষুধ উৎপাদন হওয়ায় কিছু কিছু ওষুধের দাম কমেছে। তবে আরও কমানো প্রয়োজন। কারণ সরকার এসব ওষুধের ম্যাটেরিয়াল আমদানিতে ট্যাক্স কমিয়েছে। ক্যান্সারের ওষুধের এপিআই দেশে কীভাবে উৎপাদন করা যায়, সে বিষয়েও সরকারকে গুরুত্ব দিতে হবে।”

