রাজনীতিতে ‘গ্রিন সিগন্যাল’ বা সবুজ সংকেতের ব্যবহার চলতি দিনের মতোই দৃশ্যমান। বিশেষ করে নির্বাচনে মনোনয়ন সংক্রান্ত বিষয়ে এটি প্রায় নিয়মিত হয়ে উঠেছে। মনোনয়ন না পাওয়া মানে লাল বাতি। তবুও দল বলছে, কোনো না কোনোভাবে তাদের পুষিয়ে দেওয়া হবে।
কোনো না কোনো বলতে মূলত বোঝানো হচ্ছে দলীয় বা রাষ্ট্রীয় বিকল্প পদ-পদবি দেওয়া, যা প্রার্থীদের সবুজের স্বাদ দেবে। আর এই সবুজের হাতছানির মাঝেই দেশের ব্যবসায়ীরা লাল বাতির চাপে কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন।
পান-সুপারি থেকে শুরু করে জাহাজ পর্যন্ত ছোট-বড় সব ধরনের ব্যবসায়ী প্রায় সোয়া বছর ধরে টানা অবর্ণনীয় কষ্ট ও আতঙ্কের মধ্যে ভুগছেন। ঘুরে দাঁড়ানো এখন দুরূহ, সম্প্রতি অনেকের টিকে থাকা পর্যন্ত দায় হয়ে উঠেছে। এই মাসে যেভাবে দিন যাচ্ছে, সামনের মাসে কী হবে তা নিয়ে তাদের অনিশ্চয়তা তীব্র। এ দশায় দিনাতিপাতই হয়ে উঠেছে তাদের জীবনের অংশ।
গত এক বছরে ২৫৮টি রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক প্রতিষ্ঠান প্রায় অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই এসব কারখানায় কর্মরত অনেকেই বেকার হয়েছেন। এ অবস্থায় বিনিয়োগের জন্য অপেক্ষমাণ শতাধিক প্রকল্পও থমকে গেছে।
দেশি ব্যবসায়ীরা সরাসরি বলছেন না, তবুও বিদেশিদের কাছে এ তথ্য অজানা নেই। মানি লন্ডারিং, রাজস্ব ফাঁকি, ভূমি দখল, ঋণ জালিয়াতি, অর্থ আত্মসাৎ ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের মতো অভিযোগের কারণে অনেক ব্যবসায়ী বিচারের আগেই সামাজিক মান-সম্মান হারাচ্ছেন। কখনো স্ত্রী-সন্তান, কখনো নাতিপুতিদের ওপরও অভিযোগ ঠেলানো হচ্ছে। অভিযোগের প্রমাণ থাকলে শুধু ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নয়, আরও অনেক সম্পদও জব্দ করা সম্ভব। শক্ত বিচারের আওতায় নেওয়াও জরুরি। তবে এর পরিবর্তে একতরফা ট্রায়ালে বিনিয়োগ খতম করা হচ্ছে। সামাজিক মর্যাদা নষ্ট করা হচ্ছে। এর ফলে প্রায়শই ছোট-বড় মিল-কারখানা ও প্রতিষ্ঠান বন্ধের খবর আসে। ছোটখাটো খবরগুলো গণমাধ্যমে প্রকাশ পায় না। বেকারত্বের বোঝা বাড়ছে, নতুন বেকারের সারিও যুক্ত হচ্ছে।
এ বেকারত্বের হটস্পটে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকট ও আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের সময়মতো পণ্য সরবরাহ করতে না পারার কারণে পোশাকের কার্যাদেশ অন্য দেশে চলে যাচ্ছে। একমাত্র গর্বের বিষয় রেমিট্যান্স। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে। প্রতি মাসে বাড়তি রেমিট্যান্স আসছে। আড়াই শতাংশ প্রণোদনার কারণে এই ধারা আরও ইতিবাচক।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এ বিষয়ে চাপ দিতে চেয়েছে। তবে সরকার তা কার্যকর করছে না। আইএমএফ থেমে গেছে বা প্রস্তাব সরিয়ে নিয়েছে বলে কোনো খবর নেই। তারা একবার নজর দিলে তা সহজে সরায় না, কার্যকর হওয়ার অপেক্ষা থাকে। লক্ষ্য রাখা হচ্ছে শ্রমশক্তি রপ্তানি বাড়ানো। কিন্তু এ বিষয়ে কোন দৃঢ় উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। পুরনো শ্রমবাজারের অবস্থা আরও সংকুচিত হয়ে পড়েছে। পঁচিশ সালের প্রথম ছয় মাসে শ্রমিক রপ্তানি আগের বছরের এই সময়ের তুলনায় ২৩ শতাংশ কমেছে। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, রুমানিয়া, ক্রোয়াশিয়া ও পোল্যান্ড নতুন বাজার খোলার উদ্যোগ নিলেও অগ্রগতি নেই, বরং পিছিয়েছে।
পুঁজিবাজারেও লাল দশা। অর্থনীতির ভঙ্গুর চিত্র স্পষ্ট। পুঁজিবাজারকে বলা হয় কোনো দেশের অর্থনীতির আয়না। আধুনিক বিশ্বে শেয়ারবাজার দেশের অর্থনীতির হৃত্স্পন্দন। দেশে-বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও বাজারের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতির ভাব-নমুনা দেখেন। এখন ২১টি তালিকাভুক্ত খাতেই লাল বাতি জ্বলছে। মাঝে মাঝে কিছু খাতে সবুজ বাতির ছায়া পড়ে, কিন্তু তা স্থায়ী হয় না। লাল আবার ফিরে আসে বারবার। সূচকের অদৃশ্য অবস্থান থেকে হঠাৎ ‘বিয়ারিং প্যাড’ ফেলে দেওয়া হয়। এর আঘাতে ১৬ লাখের বেশি বিনিয়োগকারী সর্বস্ব হারিয়ে বাজারছাড়া। যারা এখনও বাজারে আছেন, তারা যেন জীবন্ত লাশের মতো।
রাষ্ট্র পুঁজিবাজারকে বেহালে রেখে, ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীদের দূরে ঠেলে বদনামে ডুবিয়ে দিয়ে ফল আশা করা কতটা যুক্তিসঙ্গত, তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ দেখা গেছে গত বছরখানেকের বাংলাদেশে। প্রায় সব খাতেই এমন অবস্থার কারণে আগামীর জন্য বড় রকমের লাল সংকেত রয়েছে। দেশের অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতার মধ্যে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিও নাজুক। বিভিন্ন দাবিদাওয়ায় প্রতিদিন সড়ক-মহাসড়ক বন্ধ হয়ে আন্দোলন হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে কেবল অর্থনীতিবিদ বা ব্যবসায়ীরাই নয়, সাধারণ মানুষও উদ্বিগ্ন।
নির্বাচিত সরকার এলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে—এ আশার সঙ্গে হতাশাও সমান্তরাল। ব্যবসা-বাণিজ্যসহ অর্থনীতিতে যে বন্ধ্যত্ব ভর করেছে, তার জের কাটানো কতটা সম্ভব? রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না এলে স্বাভাবিকতার আশা কতটা পূর্ণ হবে, তা স্পষ্ট নয়। চারদিকে নতুন করে সমানে বায়নানামা। দাবির মহোৎসব চলছে। এর মধ্যে যাঁরা বড় বড় অফিসে কলম চালান, ক্ষমতাশালী—তাঁদের দাবিগুলো তুলনামূলক সহজেই পূরণ হচ্ছে। বাকিরা রাস্তায় লাঠিপেটা খাচ্ছেন।
ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীরা কোনোভাবেই রাস্তায় নামতে পারছেন না বা কলমবিরতি করতে পারছেন না। তেমনই ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে পারছেন না। দীর্ঘদিনের শ্রম ও ঘামে তৈরি করা ব্যবসার কষ্ট প্রকাশ করা কঠিন। অনেকের জন্য এটি যেন জীবনের বড় পরীক্ষা। অনবরত লোকসান ও হয়রানি, তার ওপর অপমান—সব মিলিয়ে ব্যবসায়ীর ক্ষত তৈরি হয়েছে। এর ফলে দেশি বিনিয়োগ লাটে উঠেছে, বিদেশি বিনিয়োগও স্তব্ধ। সরকার কিছু ক্ষেত্রে দেশি ব্যবসায়ী-বিনিয়োগকারীদের ভিলেন হিসেবে উপস্থাপন করেছে।
কিছু ব্যবসায়ীর ক্ষেত্রে দেখা গেছে ব্যাংক হিসাব জব্দের ঘটনাই সাধারণ হয়ে গেছে। শেখ হাসিনার পিয়ন জাহাঙ্গীর-কামরুন্নাহার দম্পতির লেভেলের নাম ধরে ব্যবসায়ীকে প্রভাবিত করার কুপ্রবণতার শিকার হয়েছেন অনেকে। যারা ব্যবসা-বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে দেশের অর্থনীতির রক্ত সঞ্চালন করছেন, তাদের একদিকে বলা হচ্ছে ‘রিয়েল হিরো’, অন্যদিকে বানানো হচ্ছে ভিলেন। বিনিয়োগ বাড়িয়ে অর্থনীতির ধমনিতে প্রাণ সঞ্চালনের আহ্বানের সমান্তরালে চলছে বিনিয়োগবিরোধী পদক্ষেপ। সাংঘর্ষিক বা ডাবলস্ট্যান্ডার্ডের শিকার ব্যবসায়ী-বিনিয়োগকারীরা চিৎকার করে কাঁদতে পারছেন না, অবিরাম সইতেও পারছেন না।
একজন ব্যবসায়ী ব্যবসায় লোকসান করলেও কর দেওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকে। ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীদের একটি সাধারণ আকাঙ্ক্ষা হলো তাঁরা রাজনীতিমুক্ত থাকুন। নিশ্চিন্তে ব্যবসায় মনোযোগী থাকতে পারেন। গুরুতর অভিযোগে জড়িত হলে অবশ্যই বিচার করতে হবে। কিন্তু তা ব্যবসা বা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া বা উৎপাদন বন্ধ করার মতো নয়। এটি ব্যবসায়ীদের মান-সম্মান ও জীবিকা বাঁচিয়ে রাখার বিষয়। ব্যবসায়ীদের কাছে এটি অর্থনৈতিকভাবে হয়রানিমূলক, সামাজিকভাবে চরম নিপীড়নমূলক এবং হিংসাত্মক। লাজশরমে অনেক ব্যবসায়ী ব্যবসা-বাণিজ্য গুটিয়ে প্রকাশ্যে বের হতে পারছেন না। নতুন বিনিয়োগের চিন্তা তো দূর, পুরনো বিনিয়োগ রক্ষার বিষয়েও অনেকে অসুবিধায় রয়েছেন।
৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর একদিকে বেশ কিছু শিল্প-কারখানা বন্ধ হয়েছে। অন্যদিকে সম্ভাবনাময় অনেক শিল্প-কারখানাও অর্থাভাবে পুনরায় ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। অর্থায়ন সংকট, ঋণ সহায়তা সমস্যা, সুদহার বৃদ্ধিও ব্যবসায়ীদের ঘুম হারাম করেছে। বিশ্বের কোনো বিনিয়োগকারীই এমন অনিশ্চয়তায় থাকতে চান না। তার ওপর অসম্মানিত হওয়ার দুশ্চিন্তা। যে পরিবেশে ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসার পায়, বিনিয়োগ বৃদ্ধি পায়, কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়—সেটি দেশে নেই। বিদেশি ব্যবসায়ীরা তুলনামূলকভাবে সাহসী, সীমাবদ্ধতাও কম। ব্যাপক বিনিয়োগ, গতিময় ব্যবসা, চাঙ্গা পুঁজিবাজার এবং অভ্যন্তরীণ সম্পদ বৃদ্ধিসহ সম্ভাবনার দরজা খোলা রাখা সরকারের জন্য বাজেট সহায়তা দিতে সহজ করে দিতে পারে। তখন বিশ্বব্যাংক বা এডিবির কাছে অতিরিক্ত ধরনা দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না।
বিনিয়োগ থাকলেই কর আদায়, নিয়োগ, ফ্যাক্টরি স্থাপন ও যন্ত্রপাতি আমদানির প্রক্রিয়া স্বাভাবিক হয়। স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের তুলনায় এসব তথ্য বিদেশিদের কাছে আরও বেশি থাকে। নিজেদের স্বার্থেই তারা তা সংগ্রহ রাখে। দেশি ও বিদেশি সব বিনিয়োগকারীই উচ্চ সুদ, বিদ্যুৎ, জ্বালানি, পরিবহন ব্যয় এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতি একইভাবে মাপেন। সামনে কী অপেক্ষা করছে, মালিকদের মনে অকস্মাৎ প্রশ্ন। কারখানা চালু রাখা, অর্ডার নেওয়া, কাঁচামাল কেনা, গ্যাস-বিদ্যুৎ বিল সামলানো—সবকিছু নিয়ে তারা অন্ধকার দেখছেন। এখনো বেকার না হওয়া শ্রমিকরা আতঙ্কে আছে।
নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন এবং শাসক পরিবর্তন ঘটেছে কিন্তু শাসনতন্ত্রের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের পরিস্থিতি সেখানকার সঙ্গে তুলনীয় নয়। এখানে সংস্কার, ঐকমত্য, মব-গুজব এবং আন্দোলনকারী ফ্রন্ট ফিগারদের নানা কার্যক্রমের কারণে ব্যবসায়ী-বিনিয়োগকারীদের শঙ্কা ও অপমানিত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নিরর্থক ডাকাডাকি করতে হয় না, তবে দেশি ব্যবসায়ীর পরিস্থিতি ভিন্ন।
মোস্তফা কামাল: সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন।

