সিদ্ধান্তহীনতা আর আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় ঝুলে আছে জাপানের উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা জাইকার অর্থায়নের পাঁচটি মেগাপ্রকল্প। মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র, মেট্রোরেল, বা শাহজালাল বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল—সব প্রকল্পই এখন থমকে আছে।
সর্বশেষ অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। কাঁচপুর-মেঘনা-গোমতী সেতু, শাহজালাল বিমানবন্দর সম্প্রসারণ, মেট্রোরেল প্রকল্প, যমুনা রেল সেতু ও মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র—সবকটিই বিভিন্ন জটিলতায় জর্জরিত। জাইকা ইতিমধ্যেই বাংলাদেশ সরকারকে সতর্ক করেছে। তারা বলেছে, যদি বাস্তবায়নে সমন্বয় ও দ্রুত সিদ্ধান্তহীনতা দূর না হয়, ভবিষ্যতে নতুন প্রকল্প অনুমোদনে আরও সতর্ক হবে।
বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়নে জাইকা দীর্ঘদিন ধরেই প্রধান সহায়তাকারী। সড়ক, সেতু, রেল, বিদ্যুৎ ও বিমানবন্দর—সবখানেই তাদের অর্থায়নে বড় প্রকল্প চলছে। একসময় উন্নয়নের রোল মডেল ছিল জাইকা অর্থায়িত প্রকল্পগুলো। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে পরিস্থিতি পাল্টেছে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর প্রায় সব বড় প্রকল্পই থমকে আছে।
শেষ হলেও হয়নি কাঁচপুর-মেঘনা-গোমতী সেতু:
‘কাঁচপুর, মেঘনা ও গোমতী দ্বিতীয় সেতু নির্মাণ ও পুরনো সেতুগুলোর পুনর্বাসন’ প্রকল্প আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হয়েছে প্রায় এক বছর আগে। কিন্তু এখনো এর আর্থিক নিষ্পত্তি সম্পন্ন হয়নি। জাপানি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান কাজ শেষে প্রায় আট কোটি টাকার অতিরিক্ত দাবি তুলেছে। এটি এখনও নিষ্পত্তির অপেক্ষায়। প্রকল্পের বিরোধ নিষ্পত্তি বোর্ড দাবি স্বীকার করলেও কত অর্থ দেওয়া হবে তা ঠিক হয়নি। ফলে প্রকল্প চালু হলেও হিসাবের খাতা এখনো বন্ধ। প্রকল্পের আর্থিক বিশ্লেষণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে মাতারবাড়ী বন্দরের পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি প্রশাসনিক জটিলতা ও সমন্বয়ের ঘাটতির প্রমাণ।
বিলম্বের গহ্বরে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সম্প্রসারণ:
শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সম্প্রসারণ প্রকল্প নানা দাবি, বিরোধ ও অনুমোদনের বিলম্বে জড়িয়ে পড়েছে। বিদেশি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান ছয় শতাধিক পরিবর্তন প্রস্তাব দিয়েছে। এর অর্ধেকেরও বেশি এখনো অনুমোদনের অপেক্ষায়। বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ঠিকাদারদের দাবি-পাল্টাদাবি মিলিয়ে এখন বিলের পরিমাণ হাজার হাজার কোটি টাকায় পৌঁছেছে। বিমান কর্তৃপক্ষ দাবি করছে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা, আর ঠিকাদার পক্ষ দাবি করছে এক হাজারেরও বেশি কোটি টাকা। এই বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য বোর্ড গঠন করা হলেও এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
জাইকার পক্ষ অভিযোগ করেছে, সরকারি অনুমোদন ও সংশোধিত প্রকল্প প্রস্তাব জমা দিতে দেরির কারণে পরামর্শক ও ঠিকাদার উভয়ের বিল আটকে গেছে। এতে প্রকল্পের সময়সূচি ভেঙে পড়েছে এবং নির্মাণ ব্যয় দিন দিন বাড়ছে। বিমানবন্দরের নতুন টার্মিনাল আংশিকভাবে প্রস্তুত হলেও পুরো কাজ শেষ হতে অন্তত দেড় বছর সময় লাগতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
যমুনা রেল সেতু ও মেট্রো রেল, জটিলতায় থমকে প্রকল্প:
যমুনা রেল সেতু—টানাপড়েনেই অগ্রগতি: যমুনা নদীর ওপর রেল সেতু নির্মাণ প্রকল্পটি দেশের রেল যোগাযোগে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এখানে দাবিদাওয়া, বিরোধ ও অনুমোদনের বিলম্ব প্রকল্পকে থমকে দিয়েছে। বেশির ভাগ কাজ শেষ হলেও দুটি প্যাকেজে এখনো বিরোধ নিষ্পত্তি হয়নি। ঠিকাদারদের কিছু দাবি মন্ত্রিপরিষদের অনুমোদনের অপেক্ষায়। তবে সংশোধিত প্রস্তাব এখনও পরিকল্পনা কমিশনে জমা পড়েনি। জাইকা জানিয়েছে, বারবার সময় বাড়ানো এবং অনুমোদনের বিলম্বের কারণে তারা প্রকল্পের অগ্রগতি নিয়ে হতাশ। দ্রুত পদক্ষেপ না হলে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে যেতে পারে এবং বকেয়া অর্থ ছাড় বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
মেট্রো রেল লাইন ১ ও ৫—স্থবির স্বপ্ন: রাজধানীর যানজট কমানোর স্বপ্ন হিসেবে শুরু হয়েছিল মেট্রো রেল প্রকল্প। কিন্তু জাইকা অর্থায়িত লাইন ১ ও ৫ এখন প্রশাসনিক জটিলতায় প্রায় থমকে আছে। লাইন ১-এর একটি বড় প্যাকেজের দরপত্র অনুমোদনের আবেদন করা হলেও জাইকা এখনও সম্মতি দেয়নি। অন্যদিকে ইউটিলিটি স্থানান্তর না হওয়ায় উত্তর বাড্ডা ও আফতাবনগর এলাকায় কাজ বন্ধ রয়েছে। লাইন ৫-এর একটি প্যাকেজে দরদাতার প্রস্তাব প্রাক্কলিত ব্যয়ের চেয়ে অনেক বেশি হওয়ায় সংশোধিত প্রকল্প প্রস্তাব জরুরি হয়ে পড়েছে। ফলে পুরো প্রকল্পের সময়সূচি ভেঙে পড়েছে।
জাইকা জানিয়েছে, প্রকল্প পরিচালক ও জাইকার কার্যালয়ের মধ্যে যোগাযোগের ঘাটতি, সিদ্ধান্ত গ্রহণে দেরি এবং বাস্তবায়ন পর্যায়ে জবাবদিহির অভাবই মূল সমস্যা।
পরিকল্পনা কমিশনের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, জাইকার ঋণে উন্মুক্ত দরপত্রের সুযোগ নেই। শুধুমাত্র জাপানের প্রতিষ্ঠানই অংশ নিতে পারে। ফলে অনেক দরদাতার প্রস্তাব প্রাক্কলিত ব্যয়ের চেয়ে বেশি পড়ছে। অন্যান্য দেশও অংশ নিলে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পেত এবং খরচ কমানো যেত। ইআরডির এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মন্ত্রণালয় চেষ্টা করছে প্রকল্প ব্যয় কমানো যায় কি না। মেট্রো রেল নির্মাণের জন্য এত ঋণ নেওয়া কঠিন। সড়ক পরিবহন ও সেতু উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান জানান, এত উচ্চমূল্যে মেট্রো রেল নির্মাণ সম্ভব নয়। এখন ব্যয় কমানোর জন্য পর্যালোচনা চলছে। জাপানের সঙ্গে আলোচনা শেষে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র—প্রযুক্তিগত ব্যর্থতায় দুঃস্বপ্ন:
সবচেয়ে আলোচিত জাইকা অর্থায়িত প্রকল্পগুলোর মধ্যে মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র এখন গভীর সংকটে। প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকার এই কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চলতি বছরের শুরু থেকে নানা প্রযুক্তিগত সমস্যায় ভুগছে। বয়লারে ছাই জমে যাওয়ার কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা অনেক কমে গেছে। ঠিকাদার সংস্থা অভিযোগ করছে, যন্ত্রের নকশায় ত্রুটি ছিল। তবে পরামর্শক সংস্থা এ দাবি অস্বীকার করছে।
প্রযুক্তিগত সমস্যার পাশাপাশি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত দাবি তুলেছে। প্রকল্প পরিচালকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিদ্যুৎকেন্দ্রের দুটি ইউনিটের সক্ষমতা ৫০ শতাংশের নিচে নেমে গেছে। এটি চুক্তির নির্ধারিত মানের অর্ধেকেরও কম। ফলে সরকারের ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১০ কোটি ডলার। জাইকা এই পরিস্থিতিকে ‘অত্যন্ত উদ্বেগজনক’ বলে মন্তব্য করেছে।
জটিলতার মূল কারণ প্রশাসনিক অদক্ষতা ও সিদ্ধান্তহীনতা:
সব প্রকল্পের আলাদা সমস্যা থাকলেও মূল সংকট তিন জায়গায় সঙ্কুচিত—চুক্তিগত অস্পষ্টতা, অনুমোদনের বিলম্ব এবং প্রশাসনিক সমন্বয়ের ঘাটতি। জাইকার মতে, বাংলাদেশের সরকারি সংস্থাগুলো সময়মতো সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। এতে শুধু খরচই বাড়ছে না, বিদেশি সহযোগীদের আস্থাও কমছে।
সরকারি কর্মকর্তারা বলছেন, জাইকার নিজস্ব প্রক্রিয়াও ধীরগতি ও জটিল। প্রতিটি সিদ্ধান্তে টোকিওর অনুমোদন নিতে হয়, ফলে সময় অনেক বেড়ে যায়। ইআরডি ও প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানাচ্ছেন, বিদেশি শর্ত ও জটিল অনুমোদন প্রক্রিয়ার কারণে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ফলে প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে, কাজ থেমে যাচ্ছে, এবং শেষ পর্যন্ত জনগণের প্রত্যাশা পূরণ হচ্ছে না।

