অনলাইন ব্যবসার আড়ালে অবৈধ ট্রেডিং ও নেটওয়ার্ক মার্কেটিং। অনলাইনে উচ্চ মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে বড় অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে কিছু প্রতিষ্ঠান, কিন্তু দেশের প্রচলিত আইনে এই ধরনের ব্যবসা নিষিদ্ধ। তবুও কিছু প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রক সংস্থার চোখ ফাঁকি দিয়ে এ ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে।
সাম্প্রতিক সময়ে এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আর্থিক লেনদেন করে লোকসানসহ নানা ধরনের ভোগান্তির অভিযোগ বাড়ছে। এর আগে কয়েকটি ট্রেডিং প্ল্যাটফর্ম সাধারণ মানুষের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে উধাও হয়েছে। অনেক সময় প্রথম বিনিয়োগকারীরা ভালো মুনাফা পান, কিন্তু পরবর্তী বিনিয়োগকারীরা বড় ধরনের ক্ষতির শিকার হন। বর্তমান সময়ে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে টাকা তুলতে বিভিন্ন ট্রেডিং মডেল ব্যবহার করা হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে ‘গোল্ড কিনেন’, বিনিয়োগ ও ‘প্রমিস মার্ট’সহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান।
গোল্ড কিনেন: অনুসন্ধানে জানা গেছে, ‘গোল্ড কিনেন’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান অনলাইনে স্বর্ণালংকার কেনাবেচার প্রতিশ্রুতি দিয়ে গ্রাহকদের কাছ থেকে টাকা নিচ্ছে। এই অ্যাপভিত্তিক প্রতিষ্ঠানটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছে। অনলাইন ব্যবসার আড়ালে অবৈধ ট্রেডিং ও নেটওয়ার্ক মার্কেটিং এখন সাধারণ মানুষকে বড় অঙ্কের অর্থ হারানোর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ‘গোল্ড কিনেন’সহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান উচ্চ মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে গ্রাহকের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। দেশের আইন অনুযায়ী এই ধরনের ব্যবসা নিষিদ্ধ, তবুও নিয়ন্ত্রক সংস্থার নজর এড়িয়ে চলছে।
প্রতিষ্ঠানটি জানায়, তাদের প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে সর্বনিম্ন ৫০০ টাকা থেকে স্বর্ণ ক্রয় এবং সংরক্ষণ শুরু করা যায়। অ্যাপ ডাউনলোড করলেই যেকোনো স্থানে ২২ ক্যারট হলমার্ক প্রত্যয়িত গোল্ড কেনা সম্ভব। প্রতি মাসে নির্ধারিত তারিখে স্বয়ংক্রিয়ভাবে গোল্ড সঞ্চয় করা যায় ‘অটো গোল্ড সেভ প্ল্যান’-এর মাধ্যমে।
অটো গোল্ড সেভিংয়ের জন্য সর্বনিম্ন ১০০০ টাকা থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত ৩, ৬ ও ১২ মাস মেয়াদে সঞ্চয় করা যায়। প্রতি মাসে নির্ধারিত অর্থের সমপরিমাণ স্বর্ণ গ্রাহকের অ্যাকাউন্টে জমা হবে। সংরক্ষিত গোল্ড যেকোনো সময় ০.৫, ১, ৫ ও ১০ গ্রামের বার বা ২ ও ৪ গ্রামের কয়েন আকারে উত্তোলন করা সম্ভব।
প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে, গ্রাহকের স্বর্ণ ঢাকা সিটি করপোরেশনের এলাকায় নিরাপদ ও বিমাকৃত ডেলিভারির মাধ্যমে পৌঁছে দেয়া হবে। এছাড়া দেশজুড়ে ৬৫০টিরও বেশি নির্বাচিত পিক-আপ পয়েন্ট রয়েছে। অ্যাপের মাধ্যমে সংরক্ষিত স্বর্ণ প্রিয়জনকে উপহারও দেওয়া যাবে। তিনটি ধাপে বিক্রয় করলে বিক্রীত অর্থ দ্রুত গ্রাহকের ব্যাংক বা মোবাইল ওয়ালেটে জমা হবে। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই অ্যাপটির কোনো বাস্তব স্বর্ণ মজুত নেই। তারা শুধু প্রচারণার মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে প্রতারণার ফাঁদে ফেলছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারাও সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশ জুয়েলারি সমিতি (বাজুস) সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটির সদস্য পদ স্থগিত করেছে।
আইটি খাতে অননুমোদিত লেনদেনে আরও বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান জড়িত। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, অন্তত ২০টি প্রতিষ্ঠান কৃষিভিত্তিক প্রকল্প বা ক্রাউড ফান্ডিং-এর আড়ালে বিনিয়োগ সংগ্রহ করছে। এসব প্রতিষ্ঠান বন্ধ হলে বা প্রতারণা করলে গ্রাহকের টাকা ফেরতের কোনো উপায় থাকবে না। অনলাইনে ঝুঁকিপূর্ণ আর্থিক কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব বর্তায় বাংলাদেশ ব্যাংক, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, ভোক্তা অধিদপ্তর, প্রতিযোগিতা কমিশন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রক সংস্থার ওপর। তাদের কঠোর নজরদারি গ্রাহককে প্রতারণার ফাঁদ থেকে রক্ষা করতে পারে।
বিনিয়োগ: ‘বিনিয়োগ’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান ট্রেডিংয়ের আড়ালে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করছে। প্রথমে একটি বিও অ্যাকাউন্ট খুলতে হয়, তারপর টাকা ডিপোজিট করতে হয়। এরপর অনলাইনে বাই-সেল অর্ডার দেওয়া যায়। প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে, ইনভেস্টররা ওয়েবসাইটের মাধ্যমে শেয়ার মার্কেট ও অন্যান্য ইনস্ট্রুমেন্টের অ্যানালাইসিস দেখে শেয়ার কিনতে এবং বিক্রি করতে পারবেন। মুনাফা তুলতে আবেদন করলে তা ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা হয়।
প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, সম্পূর্ণ কার্যক্রম অনলাইনের মাধ্যমে করা সম্ভব। তারা ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের ট্রেড হোল্ডার। তাদের মেম্বার নাম্বার ১২২। সব লেনদেন এই ট্রেড হোল্ডারের মাধ্যমে করা হয়। তবে এর অনুমোদন আছে কি না, তা নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো যাচাই করছে।
প্রমিস মার্ট: ২০১৯ সালে ‘নগদহাট বাংলাদেশ লি.’ নামে যাত্রা শুরু করা এই প্রতিষ্ঠান সম্প্রতি ‘প্রমিস মার্ট লি.’ নামে নাম পরিবর্তন করেছে। অভিযোগ রয়েছে, তারা ই-কমার্স আড়ালে মাল্টি-লেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) মডেলে ব্যবসা করছে। প্রতিষ্ঠান গ্রাহকের কাছে পণ্য বিক্রি করে এবং অন্যদের কাছে বিক্রি করানোর মাধ্যমে মুনাফা দেয়ার প্রলোভন দেখায়।
প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, পাঁচ লাখ টাকা বিনিয়োগ করলে ৩৬ মাসে গ্রাহক ৯ লাখ টাকা ফেরত পাবেন। প্রথম বিনিয়োগকারী নতুন বিনিয়োগকারীর থেকে তিন শতাংশ কমিশন পাবেন। পরবর্তী বিনিয়োগকারী এবং তার উপরের লেভেলের বিনিয়োগকারীদেরও নির্দিষ্ট কমিশন দেওয়া হয়। এতে যত বেশি বিনিয়োগ হয়, র্যাঙ্ক তত বৃদ্ধি পায়। সর্বনিম্ন র্যাঙ্ক ‘এক্সিকিউটিভ’ হওয়ার জন্য অন্তত পাঁচ লাখ টাকা বিনিয়োগ করানো প্রয়োজন।
প্রমিস মার্টের বিনিয়োগ কার্যক্রম ওয়েবসাইটের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। রেজিস্ট্রেশন করলে একটি ড্যাশবোর্ড দেখা যায়, যেখানে বিনিয়োগকারীর অ্যাকাউন্টের তথ্য এবং উত্তোলনের আবেদন করার সুবিধা থাকে। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মাসুদ আলম। কল্যাণপুরে অফিসে সরেজমিনে উপস্থিত লোকজনের সঙ্গে কথা বলে এই তথ্য পাওয়া গেছে।
খাত সংশ্লিষ্টদের মতে, অননুমোদিত ব্যবসা মডেল দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে। ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) এক নেতা জানিয়েছেন, ভবিষ্যতে বড় ধরনের কোনো প্রতারণা ঘটলে তা তথ্যপ্রযুক্তি খাতেই হবে। বর্তমানে অনেক প্রতিষ্ঠান অননুমোদিত ব্যবসা মডেলে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে টাকা তুলছে। এই টাকা অনেক ক্ষেত্রেই সঠিকভাবে ফেরত দেওয়া সম্ভব নয়। এতে বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতি ও অঘটনের সম্ভাবনা রয়েছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ‘ডিজিটাল কমার্স পরিচালনা নির্দেশিকা ২০২১’-এর ধারা ৩.১.৩-এ স্পষ্ট বলা হয়েছে, ডিজিটাল কমার্স বা ই-কমার্সের মাধ্যমে মাল্টি লেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) বা নেটওয়ার্ক ব্যবসা পরিচালনা করা যাবে না। ৩.১.১০ ধারায় উল্লেখ রয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি ব্যতীত ডিজিটাল মাধ্যমে কোনো অর্থ ব্যবসা পরিচালনা করা যাবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পেমেন্ট সিস্টেমস বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেছেন, “অননুমোদিত বিজনেস মডেলে কার্যক্রম পরিচালনা করা যাবে না। আমরা বিজ্ঞপ্তি দিয়ে মানুষকে সতর্ক করেছি, যেন কেউ এসব প্রতিষ্ঠানের প্রলোভনের ফাঁদে না পড়ে।”
ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান উপদেষ্টা ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব জানিয়েছেন, সম্প্রতি অনলাইন ট্রাভেল এজেন্সিগুলোয় কিছু জালিয়াতি ধরা পড়েছে। তারা এই কেসগুলো নিয়ে কাজ করছে। সার্বিকভাবে অনলাইন ব্যবসাকে শৃঙ্খলায় আনার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে তিনি সেন্ট্রাল লজিস্টিক ট্রাকিং প্ল্যাটফর্ম (সিএলটিপি) চালুর উদ্যোগ উল্লেখ করেছেন, যাতে পণ্য ডেলিভারির আগে প্রতিষ্ঠান গ্রাহকের টাকা নিতে না পারে। তিনি বলেন, “সিএলটিপি সম্পূর্ণভাবে ব্যবহার করলে অনলাইনে সম্পদ কেন্দ্রীভূত করে প্রতারণার সুযোগ থাকবে না। বাণিজ্য ও অর্থ মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে এতে যুক্ত করতে হবে।”
অতীতে যুবক, ডেসটিনি, ইউনিপেটইউসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের অননুমোদিত কর্মকাণ্ডে অনেক গ্রাহক কষ্টার্জিত অর্থ হারিয়েছেন। অর্থনীতিবিদদের মতে, দেশে ব্যাংকিং চ্যানেলে সুদের হার কম থাকায় সাধারণ মানুষ অপেক্ষাকৃত বেশি মুনাফার আশায় ঝুঁকিপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে অর্থ বিনিয়োগ করেন। তারা ভুলে যান, অনুমোদনহীন প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রতারণা হলে তা থেকে রক্ষা পাওয়া খুবই কঠিন। সামান্য সংকটের সময়ও এসব প্রতিষ্ঠানের পক্ষে গ্রাহকের টাকা ফেরত দেয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে যায়।

