চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ৫২ শতাংশ কমে গেছে। তবে একই সময় ব্যাংকে আমানত বাড়ছে। জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরের একই সময়ে সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল ৪ হাজার ১০৯ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে তা নেমে এসেছে মাত্র ১ হাজার ৯৪৫ কোটি টাকায়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা যায়, জুলাই-আগস্ট মাসে ব্যাংক খাতে আমানত বেড়েছে প্রায় ২৭ হাজার ৭৪০ কোটি টাকা। আগস্ট মাসের শেষে আমানতের প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ০২ শতাংশ, যা গত দেড় বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)-এর পরামর্শে সঞ্চয়পত্রের সুদহার বাজারভিত্তিক করা হয়েছে। এর ফলে সুদের হার কিছুটা কমেছে। অর্থবছরের শুরুতেই তাই দেশের সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে বড় ধরনের ধস দেখা গেছে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমার পেছনে রয়েছে কয়েকটি কাঠামোগত ও নীতিগত কারণ। সম্প্রতি ব্যাংকে আমানতের সুদের হার বেড়েছে। আগে ব্যাংকে জমা রাখলে কম সুদ পাওয়ায় মানুষ সঞ্চয়পত্রে বেশি ঝুঁকত। এখন ব্যাংক ও সঞ্চয়পত্রের সুদের ব্যবধান কমে যাওয়ায় অনেকেই ব্যাংকে টাকা রাখাকে নিরাপদ ও সুবিধাজনক মনে করছেন।
চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি প্রায় ৫২ শতাংশ কমেছে। এর সঙ্গে সরকার নতুন বিধিনিষেধও আরোপ করেছে। এখন সঞ্চয়পত্র কিনতে জাতীয় পরিচয়পত্র, ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নম্বর (টিআইএন) ও ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে যাচাই বাধ্যতামূলক। এতে বিশেষ করে গ্রামীণ ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত বিনিয়োগকারীরা প্রক্রিয়ার জটিলতায় নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। দেশে চলমান উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি ও জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধিও বিনিয়োগকে বাধাগ্রস্ত করেছে। সাধারণ মানুষ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য কিনতেও হিমশিম খাচ্ছে, ফলে সঞ্চয় করার ক্ষমতা আগের তুলনায় অনেক কমে গেছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমে যাওয়া সরকারের জন্য একটি সতর্কবার্তা। এটি শুধু ঋণ সংগ্রহ প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করছে না, বরং সাধারণ মানুষের সঞ্চয় প্রবণতা ও আর্থিক আস্থার পতনও নির্দেশ করছে। সরকার সাধারণত অভ্যন্তরীণ ঋণের বড় অংশ সংগ্রহ করে সঞ্চয়পত্র ও ব্যাংক ঋণের মাধ্যমে। সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমে যাওয়ায় সরকার এখন তুলনামূলকভাবে বেশি ব্যয়বহুল ব্যাংক ঋণের দিকে ঝুঁকছে। এতে সুদ ব্যয়ের চাপ বাড়ছে এবং ব্যাংক খাতে ঋণের চাহিদা বেড়ে যাচ্ছি, যা বেসরকারি খাতের বিনিয়োগকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করতে পারে। ফলে সামষ্টিক অর্থনীতিতে ভারসাম্যহীনতা তৈরি হতে পারে।
বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, ‘দেশের অর্থনীতিতে বিনিয়োগ, মজুরি ও শ্রমবাজার কোথাও বেশি সুখবর নেই। উচ্চ মূল্যস্ফীতি স্থিতিশীল থাকায় মানুষের আয় না বাড়লেও ব্যয় বাড়ছে। এ অবস্থায় নতুন করে সঞ্চয় করার ক্ষমতা অধিকাংশ মানুষের নেই। সুদহারও কিছুটা কমেছে। সরকারের করা সঞ্চয়পত্র সংস্কার মূলত সুদহারকে বাজারভিত্তিক করার উদ্দেশ্যে করা হয়েছে, সুদহার কমানোর জন্য নয়। আইএমএফেরও পরামর্শ রয়েছে যাতে সঞ্চয়পত্র থেকে অতিরিক্ত ঋণ নেওয়া না হয়।’ আইএমএফের পরামর্শে সঞ্চয়পত্রের সুদহার এখন সরকারি ট্রেজারি বিলের সঙ্গে যুক্ত। ছয় মাসের গড় ট্রেজারি বিলের সুদহার অনুযায়ী সঞ্চয়পত্রের সুদ নির্ধারণ হবে। ট্রেজারি বিলের সুদ বাড়লে সঞ্চয়পত্রের সুদ বাড়বে, কমলে কমবে।
জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে সঞ্চয়পত্রে নিট বিক্রি হয়েছে ১ হাজার ৯৪৫ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই সময়ে নিট বিক্রি হয়েছিল ৪ হাজার ১০৯ কোটি টাকা। এতে নিট বিক্রি কমেছে প্রায় ৫২.৬৬ শতাংশ। তবে অতীতের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী, বিক্রি বাড়লেও পরবর্তীতে ভাঙার প্রবণতা বেড়ে গেলে ঋণাত্মক পরিস্থিতি তৈরি হয়।
চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের নিট ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এটি আগের অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রা ১৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকার তুলনায় কম। বিক্রির নেতিবাচক ধারা অব্যাহত থাকায় সংশোধিত বাজেটে এটি আরও কমিয়ে ১৪ হাজার কোটি টাকায় আনা হয়েছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি ঋণাত্মক ছিল প্রায় ৬ হাজার ৬৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ সঞ্চয়পত্র থেকে সরকার যে ঋণ পেয়েছে, তার চেয়ে এ সময়ে বেশি পরিশোধ করতে হয়েছে। এই কারণেই ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা আরও কমানো হয়েছে।

