রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) ও অন্যান্য সরকারি সংস্থার সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪–২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) সেবা রপ্তানি মাত্র ৭২৪ দশমিক ৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার হয়েছে। এটি নির্ধারিত ৫ বিলিয়ন ডলারের লক্ষ্যের তুলনায় অনেক কম।
এই অর্থবছরে আইসিটি রপ্তানি আগের বছরের তুলনায় ৭ দশমিক ৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশ যথেষ্ট পিছিয়ে। একই সময়ে পাকিস্তান ১৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৩ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলারের আইটি সেবা রপ্তানি করেছে। আর বিশ্বে নেতৃত্ব ধরে রাখা ভারত আইটি খাতে ১২ দশমিক ৪৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে আনুমানিক ২২৪ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানিতে পৌঁছেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, কাঠামোগত অপ্রতুলতা ও প্রতিযোগিতামূলক দক্ষতার ঘাটতি বাংলাদেশের আইসিটি রপ্তানি বৃদ্ধির পথে প্রধান বাধা। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাতের উদ্যোগ বাড়ানো না হলে লক্ষ্য অর্জন কঠিন হয়ে যাবে।
কম্পিউটার সেবা খাতই বাংলাদেশে আইসিটি রপ্তানির প্রধান চালিকা শক্তি:
বাংলাদেশের আইসিটি রপ্তানিতে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছে কম্পিউটার সেবা খাত। ২০২৪–২৫ অর্থবছরে দেশের মোট আইসিটি রপ্তানির প্রায় ৮৭ শতাংশ এসেছে কম্পিউটার সেবা থেকে। এতে রয়েছে সফটওয়্যার উন্নয়ন, আউটসোর্সিং এবং তথ্যপ্রযুক্তি-সক্ষম সেবা (আইটিইএস)। বাকি ১৩ শতাংশ এসেছে টেলিযোগাযোগ সেবা থেকে, আর তথ্যসেবা থেকে এসেছে ১ শতাংশেরও কম।
কম্পিউটার সেবা খাতের রপ্তানি ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৮–১৯ অর্থবছরে এটি ছিল ২৩৯ দশমিক ৯ মিলিয়ন ডলার। ২০২৪–২৫ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬২৯ দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলারে। বৈশ্বিক পর্যায়ে ডিজিটাল সমাধান, রিমোট ওয়ার্ক এবং অটোমেশন সেবার চাহিদা বৃদ্ধিই এই প্রবৃদ্ধির মূল কারণ। বর্তমানে বাংলাদেশে ৪,৫০০-এর বেশি সফটওয়্যার ও আইটি-সক্ষম সেবা প্রতিষ্ঠান কার্যক্রম চালাচ্ছে। এখানে তিন লাখেরও বেশি পেশাজীবী কর্মরত। এর মধ্যে প্রায় অর্ধেক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস)-এর সদস্য।
বেসিসের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত শীর্ষ আইসিটি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে সার্ভিস ইঞ্জিন, গ্রাফিক পিপল, বিআইজিআইটি, থেরাপ (বিডি), ব্রেইন স্টেশন ২৩, সিকিউর লিংক সার্ভিসেস বাংলাদেশ, সেফালো বাংলাদেশ, কাজ সফটওয়্যার, গোল্ডেন হারভেস্ট ইনফোটেক এবং ডায়নামিক সলিউশন ইনোভেটর্স।
আইসিটি রপ্তানি বৃদ্ধির পথে বাধা:
খাত সংশ্লিষ্টদের মতে, বাংলাদেশের আইসিটি রপ্তানি প্রবৃদ্ধি থমকে যাওয়ার মূল কারণ হলো কম বিনিয়োগ, নীতিগত ঘাটতি, বেসরকারি খাতের সীমিত প্রস্তুতি, দক্ষ জনবলের অভাব এবং দুর্নীতি। বেসিসের সাবেক সভাপতি হাবিবুল্লাহ নেয়ামুল করিম বলেন, “সরকারি হিসাব অনুযায়ী আইটি রপ্তানি মাত্র ৬০০ মিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি। তবে আমাদের বিশ্বাস, প্রকৃত পরিমাণ এক বিলিয়ন ডলারেরও বেশি হতে পারে। কারণ ফ্রিল্যান্সার, ছোট আউটসোর্সিং প্রতিষ্ঠান এবং বিদেশি অংশীদারিত্বে পরিচালিত কিছু কোম্পানির আয় সরকারি পরিসংখ্যানে ধরা পড়ে না।” তিনি আরও বলেন, খাতটির প্রবৃদ্ধি এখনো মূলত প্রাকৃতিকভাবে হচ্ছে। অর্থাৎ ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের পুনঃবিনিয়োগ করা লাভ দিয়েই এই খাত এগোচ্ছে।
“এ ধরনের অর্গানিক প্রবৃদ্ধিতে বছরে ১০ থেকে ১৫ শতাংশের বেশি বৃদ্ধি পাওয়া কঠিন। যদি মোট বাজার এক থেকে দেড় বিলিয়ন ডলার হয় এবং নিট মুনাফা থাকে ৫ শতাংশ, তাহলে বছরে মাত্র ৭৫ থেকে ১০০ মিলিয়ন ডলার পুনঃবিনিয়োগ হচ্ছে। কিন্তু ৫ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি লক্ষ্য অর্জন করতে অন্তত ১০ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ প্রয়োজন,” বলেন নেয়ামুল করিম। তিনি জোর দিয়ে বলেন, খাতে টেকসই প্রবৃদ্ধি আনতে দেশীয় ও বিদেশি—দুই দিক থেকেই বড় বিনিয়োগ জরুরি। “সরকার যদি প্রশিক্ষণ প্রণোদনা, নিয়োগ সহায়তা ও কর–সুবিধা দেয়, যেমনটা ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন ও ভারতে দেখা যায়, তাহলে দেশীয় ও বিদেশি উভয় বিনিয়োগই বাড়বে,” যোগ করেন তিনি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের বড় শিল্পগোষ্ঠী মূলত উৎপাদন খাতে বিনিয়োগে আগ্রহী। কারণ সেখানে মুনাফা দ্রুত ও স্পষ্টভাবে দেখা যায়। অন্যদিকে, আইসিটি খাতে বিনিয়োগ মূলত অদৃশ্য খাতে যায়। যেমন দক্ষতা উন্নয়ন, বিপণন, মানবসম্পদ ও বেতন খাতে ব্যয় হয়। এসব ক্ষেত্রে মুনাফা পেতে সময় লাগে। ফলে বড় বিনিয়োগকারীরা এ খাতে ঝুঁকি নিতে চায় না।
মার্কেট ইন্টেলিজেন্স প্রতিষ্ঠান মরডর ইন্টেলিজেন্সের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালে বাংলাদেশের আইসিটি মার্কেটের আকার দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৮৮ বিলিয়ন ডলারে। ধারণা করা হচ্ছে, ২০৩০ সালের মধ্যে এটি বৃদ্ধি পেয়ে ১২ দশমিক ০৭ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে। চলতি ২০২৫ সালের মধ্যে আইসিটি খাত ৫ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি এবং ২০৩১ সালের মধ্যে ২০ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানির লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল।
দক্ষতা উন্নয়নই বাংলাদেশের আইসিটি রপ্তানির মূল চালিকা শক্তি:
বেসিসের তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে আইসিটি খাতে কর্মরত পেশাজীবীর সংখ্যা প্রায় পাঁচ লাখ। শিল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উদীয়মান প্রযুক্তিতে লক্ষ্যভিত্তিক দক্ষতা উন্নয়নই বাংলাদেশের রপ্তানি সম্ভাবনা উন্মোচনের মূল চাবিকাঠি। ব্রেইন স্টেশন ২৩–এর প্রধান অর্থ কর্মকর্তা মুসাব্বির আলম বলেন, “ব্যয়-সাশ্রয়ী শ্রমবাজার ও বিপুল মানবসম্পদের কারণে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা করতে পারে। তবে আমাদের জনবলকে সঠিকভাবে প্রশিক্ষিত ও বৈশ্বিকভাবে উপস্থাপন করাই সবচেয়ে জরুরি।”
বেসিসের সাবেক সভাপতি হাবিবুল্লাহ নেয়ামুল করিম জানান, প্রতিবছর ৮০ থেকে ৯০ হাজার প্রকৌশলী স্নাতক কর্মবাজারে প্রবেশ করেন, তবে অনেকেই বেকার থাকে। তিনি বলেন, “যদি আমরা তাদের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই), কম্পিউটার ভিশন, ব্লকচেইন, ড্রোন সফটওয়্যার ও থ্রিডি প্রিন্টিংয়ে প্রশিক্ষিত করতে পারি, তাহলে তারা বাংলাদেশ থেকেই বিশ্বব্যাপী ক্লায়েন্টদের সেবা দিতে পারবে।” করিম আরও যোগ করেন, “সেমিকন্ডাক্টর ডিজাইন ও থ্রিডি প্রিন্টিংয়ে কিছু সফলতা এসেছে, তবে পরিসর এখনো ছোট। প্রতিটি উপখাতে অন্তত ১০ থেকে ২০ হাজার দক্ষ কর্মী গড়ে তোলা জরুরি।”
বৈষম্যমূলক নীতি ও ব্যাংকিং বাধা:
আইসিটি উদ্যোক্তারা অভিযোগ করেছেন, তৈরি পোশাক (আরএমজি) খাতের তুলনায় তথ্যপ্রযুক্তি খাত এখনো সমান সুযোগ-সুবিধা পায় না। টাইগার আইটির নির্বাহী পরিচালক রিফাত আবেদিন বলেন, “গত ২০ বছর ধরে শুনছি সরকার রপ্তানি খাতে বৈচিত্র্য আনতে চায়, কিন্তু সব সুবিধা এখনো পোশাক খাতেই সীমিত। আইটি খাত একই ধরনের সহায়তা পায় না।”
তিনি আরও জানান, ব্যাংকিং নীতির সীমাবদ্ধতাও খাতটির বড় বাধা। “একটি ব্যাংক গ্যারান্টি পেতে আমাদের ১০০ শতাংশ মার্জিন, অর্থাৎ ২৫ কোটি টাকা জামানত রাখতে বলা হয়েছে। পাঁচ বছর ওই টাকা আটকে রাখলে ব্যবসার ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল কোথা থেকে আসবে?” প্রশ্ন তোলেন রিফাত। এছাড়া তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের দীর্ঘমেয়াদি পারফরম্যান্স গ্যারান্টি সংক্রান্ত বিধিনিষেধের সমালোচনা করে বলেন, “এই নীতির কারণে স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলো বৈশ্বিক প্রকল্পে অংশগ্রহণের যোগ্যতা হারাচ্ছে।”

