আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থা (আইইএ) সতর্ক করেছে, আগামী এক দশকে এলএনজি আমদানির ওপর ক্রমবর্ধমান নির্ভরতা বাংলাদেশের অর্থনীতি ও জ্বালানি নিরাপত্তাকে মারাত্মকভাবে ঝুঁকিতে ফেলতে পারে। সংস্থাটির ওয়ার্ল্ড এনার্জি আউটলুক ২০২৫ প্রতিবেদনে এই আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে, যা গত বুধবার প্রকাশিত হয়েছে।
প্রতিবেদনটি জানিয়েছে, বাংলাদেশের জ্বালানির চাহিদা দ্রুত বাড়ছে, কিন্তু দেশীয় গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে উৎপাদন কমে যাচ্ছে। একই সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উপকূলীয় জ্বালানি অবকাঠামো নানা দুর্বলতার মুখে পড়েছে। চাহিদার চাপ, মজুতের ঘাটতি ও জলবায়ু ঝুঁকি একত্রিত হয়ে দেশের জ্বালানি ব্যবস্থাকে অস্থিতিশীল করছে।
আইইএর হিসাব অনুযায়ী, ২০৩৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের যৌথ এলএনজি আমদানি প্রায় ৮০ বিলিয়ন ঘনমিটার হবে, যা ২০২৪ সালের তুলনায় প্রায় ৬০ শতাংশ বেশি। এর অর্থ, দক্ষিণ এশিয়ার দুই দেশ আগামী এক দশকে বৈশ্বিক জ্বালানি বাজারের ওঠানামার ওপর আরও গভীরভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়বে।
একসময় বাংলাদেশ গ্যাসভিত্তিক স্বনির্ভরতার ওপর দাঁড়িয়ে ছিল। সিলেট, বিবিয়ানা ও তিতাস গ্যাসক্ষেত্র থেকে সরবরাহ পাওয়া গ্যাসেই চলত বিদ্যুৎ উৎপাদন ও শিল্পকারখানা। কিন্তু বর্তমানে দেশীয় গ্যাস উৎপাদন দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে, চাহিদা বাড়ছে শিল্পায়ন ও নগরায়নের কারণে। ফলে সরকার ২০১৮ সাল থেকে এলএনজি আমদানি শুরু করে। তখন এটি ছিল ‘অন্তর্বর্তী সমাধান’। কিন্তু ২০২৫ সালে দেখা যাচ্ছে, এই নির্ভরতা স্থায়ী হয়ে গেছে। এখন দেশের মোট গ্যাস ব্যবহার্যের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ আসে আমদানিকৃত এলএনজি থেকে।
এই পরিস্থিতি বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ বাড়াচ্ছে। জ্বালানির দাম ও বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচও বেড়েছে। আইইএ জানিয়েছে, উচ্চ আমদানি মূল্য, সীমিত সংরক্ষণ ও পুনরায় গ্যাসে রূপান্তর করার সক্ষমতা, সঙ্গে জলবায়ু ঝুঁকি মিলিয়ে এলএনজিনির্ভর বর্তমান মডেলকে অর্থনৈতিক ও পরিবেশগতভাবে অস্থিতিশীল করে দিয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ২০২৩ সালে একাধিক ঘূর্ণিঝড় ও বন্যায় উপকূলীয় গ্যাস টার্মিনাল ও বিদ্যুৎকেন্দ্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে এলএনজি সরবরাহ ব্যাহত হয় এবং কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায়। আইইএ মন্তব্য করেছে, এসব ঘটনা দেখিয়েছে উপকূলীয় জ্বালানি স্থাপনাগুলো জলবায়ু ঝুঁকিতে কতটা ভঙ্গুর।
এলএনজির দাম বৈশ্বিক বাজারে অতি অস্থির। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর বিশ্ববাজারে দাম বেড়েছিল প্রায় তিনগুণ। যদিও ২০৩০ থেকে ২০৩৫ সালের মধ্যে প্রতি এমবিটিইউ দাম কমে প্রায় ৭.৫ ডলার হতে পারে, বাংলাদেশ সেই সুবিধা পুরোপুরি নিতে পারবে না। কারণ দেশের অবকাঠামো সীমিত, গ্যাস সংরক্ষণ ও অর্থায়ন কম, নতুন আমদানি বাড়াতে বাধা সৃষ্টি করছে। দেশে অবকাঠামোর দুর্বলতা রয়েছে। এলএনজি টার্মিনাল দুটি সমুদ্র উপকূলে, যা জলবায়ু বিপর্যয়ে বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিদেশি ঋণের চাপের কারণে নতুন টার্মিনাল বা স্টোরেজ নির্মাণে অর্থ জোগাড়ও কঠিন।
নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে অগ্রগতি ধীর। সরকার ২০৪০ সালের মধ্যে মোট বিদ্যুতের ৩০ শতাংশ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদনের প্রতিশ্রুতি দিলেও বর্তমান তা পূরণ হয়নি। সৌর ও বায়ু শক্তি মিলিয়ে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের মাত্র ৫ শতাংশেরও কম আসে।
আইইএ মনে করছে, নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে দ্রুত বিনিয়োগ ও উৎপাদন বাড়ালে দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও বায়ু মান দুইই উন্নত হবে। জ্বালানি উৎসে বৈচিত্র্য আনলে বাংলাদেশ স্থিতিশীল ও টেকসইভাবে এগোতে পারবে। সংস্থাটি সতর্ক করেছে, যদি বৈচিত্র্য না আনা হয়, বছরে জ্বালানি আমদানি ও জলবায়ু অভিযোজন খাতে ব্যয় কয়েক বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাতে পারে।
আইইএ বলেছে, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ জ্বালানি নিরাপত্তা শুধু উৎসের ধরন নয়, বরং জলবায়ুর প্রভাব সামলানোর ক্ষমতা ও উন্নয়ন ও টেকসইতার ভারসাম্য রক্ষার ওপর নির্ভর করছে। সংক্ষেপে, দেশের জ্বালানি নীতিতে কাঠামোগত সংস্কার না আনা ও নবায়নযোগ্য উৎসে বিনিয়োগ না বাড়ালে, আগামী দশকে এলএনজি নির্ভরতা দেশের অর্থনীতি ও পরিবেশ উভয়কেই সংকটে ফেলতে পারে।

