শেষ পর্যন্ত সরকারি কর্মচারীদের জন্য নতুন পে স্কেল ঘোষণা হলো না। নিয়ম অনুযায়ী বেতন বাড়ানো সরকারের দায়িত্ব। তবে বাংলাদেশে নতুন পে স্কেল এলে বাজারে হইচই শুরু হয়। কারণ অতীত অভিজ্ঞতায় দেখা যায় পে স্কেলের ঘোষণা আসলেই বাজারে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ে। এতে বেসরকারি ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের কর্মীরা সংকটে পড়েন। এই অভিযোগ নতুন নয় তাই গণমাধ্যমেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা থেমে থাকে না।
তবে এটাও সত্য সরকার বহুদিন ধরে নতুন পে স্কেল দেয়নি। তারপরও মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। এমন অবস্থায় অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ জানালেন নতুন পে স্কেল এখন নয় নতুন সরকার আসার পরই হবে। এ ঘোষণার পরও জনমনে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে।
মূল সমস্যা রাজস্ব ব্যবস্থাপনায়। কর–জিডিপির অনুপাত বহু বছর ধরেই খুব কম। গত ১৭ বছরে জিডিপির আকার বড় হয়েছে কিন্তু সেই হারে রাজস্ব আদায় বাড়েনি। এর মধ্যে গত দেড় বছরে অর্থনৈতিক কার্যক্রম ধীর হয়ে এসেছে। প্রবৃদ্ধি কমেছে। স্বাভাবিকভাবেই রাজস্ব কমছে। এই বাস্তবতায় অন্তর্বর্তী সরকারের সিদ্ধান্ত অনেকের মতে দায়িত্বশীল পদক্ষেপ।
একসময় দেশে উচ্চ প্রবৃদ্ধির সঙ্গে মূল্যস্ফীতিও বাড়ত কিন্তু রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের পর টানা তিন বছরের বেশি সময় ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি চলছে। কখনো তা দুই অঙ্কেও পৌঁছেছে। কয়েক মাস ধরে কিছুটা কমলেও ৮ শতাংশের বেশি মূল্যস্ফীতি এখনো কঠিন বাস্তবতা। এতে জনজীবনের চাপ কমেনি। এ পরিস্থিতিতে সবারই বেতন বাড়ানো প্রয়োজন—এ কথা অস্বীকার করা যায় না। সরকারি কর্মচারীদের বেতন বাড়ানো স্বাভাবিক ও কাঙ্ক্ষিত।
সরকারি চাকরিতে সর্বশেষ পে কমিশন হয় ২০১৫ সালে। এরপর প্রতি বছর গড়ে ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট মিলেছে। অর্থাৎ প্রায় ১০ বছর ধরে একই স্কেলে চাকরি করছেন তারা। বিশেষ করে নিচের গ্রেডের বেতন বর্তমান বাজারদরের তুলনায় খুবই কম। তাই তাদের বেতন বৃদ্ধির প্রয়োজন স্পষ্ট। দুর্নীতিতে জড়িতদের প্রসঙ্গ আলাদা। তবে শুধু বেতন বাড়িয়ে জনজীবন সহনীয় করা সম্ভব নয়। সবচেয়ে জরুরি রাজস্ব আদায় বাড়ানো। পাশাপাশি সরকারি ও বেসরকারি খাতের বৈষম্য এখনো রয়ে গেছে।
রাজস্ব আদায় কম:
বাংলাদেশে কর–জিডিপির অনুপাত ঐতিহাসিকভাবেই কম। কর ফাঁকি এখনো বহু মানুষের কাছে কৃতিত্বের কাজ মনে হয়। অসাধু কর কর্মকর্তারা এ সুযোগ নেন। সরকার রাজস্ব সংগ্রহে জোর দিলেও ২০২৪–২৫ অর্থবছরে কর–জিডিপির অনুপাত আরও কমে দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক ৬ শতাংশে। আগের অর্থবছরে এই হার ছিল ৭ দশমিক ৪ শতাংশ। এনবিআর চেয়ারম্যান সম্প্রতি সিপিডির এক অনুষ্ঠানে এ তথ্য তুলে ধরেন।
দেশে কর ফাঁকি ক্রমেই বাড়ছে। সিপিডির হিসাব অনুযায়ী ২০২৩ সালে মোট কর ফাঁকির পরিমাণ আনুমানিক ২ লাখ ২৬ হাজার ২৩৬ কোটি টাকা। এর অর্ধেকই করপোরেট খাতে, যা প্রায় ১ লাখ ১৩ হাজার ১১৮ কোটি টাকা। গবেষণায় দেখা যায় ২০১১ সালের পর থেকে কর ফাঁকি উদ্বেগজনকভাবে বাড়তে শুরু করে। ২০১২ সালে কর ফাঁকি ছিল ৯৬ হাজার ৫০৩ কোটি টাকা। ২০১৫ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১ লাখ ৩৩ হাজার ৬৭৩ কোটি টাকায়। সিপিডির মতে, উচ্চ করহার দুর্বল নজরদারি জটিল আইন–কানুন এবং কর ব্যবস্থার দুর্নীতিই কর ফাঁকি বৃদ্ধির মূল কারণ। এর সঙ্গে করছাড় ও বিভিন্ন প্রণোদনার কারণেও প্রতিবছর বড় অঙ্কের রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। বিনিয়োগ উৎসাহিত করার নামে খাতভিত্তিক নানা করছাড় দেওয়া হচ্ছে। এর ফলে সরকারের ব্যয়ের সক্ষমতা কমে যাচ্ছে।
সরকারের আয় যেমন কম ব্যয়ও তেমন সীমিত। অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে বাংলাদেশের সরকারি ব্যয় জিডিপির মাত্র ১৩ শতাংশ। তুলনামূলকভাবে ভারতে এই হার ২৮ দশমিক ৮ শতাংশ ভিয়েতনামে ২০ দশমিক ৪ শতাংশ মালয়েশিয়ায় ২২ দশমিক ৩ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্রে ৩৬ দশমিক ৮ শতাংশ সুইডেনে ৪৯ দশমিক ৪ শতাংশ এবং ফ্রান্সে ৫৭ শতাংশ। অর্থাৎ সাধারণ মানুষের জন্য সরকারের ব্যয় যতটা বড় আকারে উপস্থাপন করা হয় বাস্তবে তা অনেক কম।
আরেকটি বড় বিষয় হলো ব্যয়ের গঠন। প্রতি অর্থবছরে সরকারের বেশির ভাগ ব্যয়ই পরিচালন খাতে যায়। বেতন ভাতা পেনশন সুদ পরিশোধ ভর্তুকি ও মঞ্জুরিতেই বড় অংশ খরচ হয়। উন্নয়ন খাতে ব্যয়ের অংশ তাই তুলনামূলকভাবে কম। অর্থাৎ মানব উন্নয়নে সরকারের বিনিয়োগ কম। এটাও সত্য বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারি খাতের কর্মচারীদের বেতন দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশের তুলনায় কম। আইএলওর হিসাবে গড় মজুরিও এশিয়া–প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সবচেয়ে কম।
উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও নিম্ন প্রবৃদ্ধি:
বাংলাদেশে এখন উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও নিম্ন প্রবৃদ্ধির কঠিন বাস্তবতা বিরাজ করছে। বিবিএসের তথ্য বলছে ২০২৪–২৫ অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩ দশমিক ৬৯ শতাংশ। একই সময়ে গড় মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ০৩ শতাংশ। অর্থাৎ অর্থনীতি বাড়ছে কম হারে কিন্তু পণ্যের দাম বাড়ছে দ্রুত।
পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর পরিস্থিতি তুলনামূলকভাবে ভালো। ২০২২ সালে দেউলিয়া হওয়া শ্রীলঙ্কায় চলতি বছরের বেশির ভাগ সময় মূল্যহ্রাস হয়েছে। অক্টোবর মাসে তাদের মূল্যস্ফীতি মাত্র ২ দশমিক ১০ শতাংশ। পাকিস্তানে ২০২৩ সালে মূল্যস্ফীতি ৩৫ শতাংশ ছাড়িয়ে গিয়েছিল। এখন তা কমে ৬ শতাংশের ঘরে। আমাদের দেশে মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের ভিত্তি থেকে কিছুটা নেমে ৮ শতাংশের ঘরে এলেও মানুষের জীবনে তার কোনো স্বস্তি নেই।
ভারতে এখন মূল্যস্ফীতি প্রায় নেই—শূন্য দশমিক ৫০ শতাংশ। নেপালে তা ১ দশমিক ৮৭ শতাংশ। দক্ষিণ এশিয়ার এসব দেশের তুলনায় বাংলাদেশের মানুষ এখন সবচেয়ে বেশি চাপের মধ্যে আছে। তবুও সরকারি কর্মকর্তারা মূল্যস্ফীতি কমার কথা বলেছেন। কিন্তু মূল্যস্ফীতি কমা মানে পণ্যের দাম কমা নয়। এখনো পণ্যের দাম ৮ শতাংশের বেশি হারে বাড়ছে। আগে ১২ শতাংশ হারে বাড়ত, এখন বাড়ছে ৮ শতাংশ হারে, কিন্তু দাম তো কমছে না—বাড়ছেই। এ কারণেই সাধারণ মানুষ কোনো স্বস্তি অনুভব করছে না। স্বস্তি তখনই আসবে যখন পণ্যের দাম বাস্তবেই কমবে। প্রধান খাদ্যপণ্য চালের দাম এখনও বাড়তি। অন্যান্য পণ্যের দামও প্রতিবেশী দেশের তুলনায় বেশি। দুই অঙ্কের ভিত্তি ধরে মূল্যবৃদ্ধি চলায় জীবনযাত্রার ব্যয় লাগামছাড়া হয়ে আছে।
বেড়েছে দারিদ্র্য, কমেছে বিনিয়োগ:
দেশে আয় ও কর্মসংস্থানের সুযোগ আগের তুলনায় কমেছে। তিন বছরের ব্যবধানে দারিদ্র্য না কমে উল্টো বেড়েছে। বর্তমানে দারিদ্র্যের হার ২৭ দশমিক ৯৩ বা প্রায় ২৮ শতাংশ। সরকারি হিসাব অনুসারে ২০২২ সালে এই হার ছিল ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিপিআরসির ‘ইকোনমিক ডায়নামিকস অ্যান্ড মুড অ্যাট হাউসহোল্ড লেভেল ইন মিড ২০২৫’ শীর্ষক গবেষণায় বলা হয়েছে দেশের মানুষ এখনো তিনটি সংকটের চাপের মধ্যে আছে—কোভিড (২০২০–২২), মূল্যস্ফীতি এবং রাজনৈতিক–অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা।
গবেষণা বলছে দেশে অতিদারিদ্র্যের হারও বেড়েছে। সরকারি হিসাব অনুযায়ী ২০২২ সালে অতিদারিদ্র্যের হার ছিল ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। ২০২৫ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৩৫ শতাংশে। গত তিন বছরে দারিদ্র্যের হার বেড়েছে এবং এখনো ১৮ শতাংশ পরিবার যেকোনো সময় আবার দারিদ্র্যে ফিরে যেতে পারে।
এদিকে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ব্যাংকঋণের উচ্চ সুদের কারণে বেসরকারি বিনিয়োগ স্থবির হয়ে আছে। ফলে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবৃদ্ধি কমে গেছে। গত অর্থবছরজুড়ে প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ৭ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে তা আরও কমেছে। সর্বশেষ আগস্টে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে ৬ দশমিক ৩৫ শতাংশে—যা গত ২২ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।
এ অবস্থায় মানুষের বেতন বাড়ানোর প্রয়োজন আছে—এটি মানবিক অধিকারও বটে। তবে কেবল সরকারি কর্মচারীদের বেতন বাড়ালেই চলবে না। বেসরকারি খাতের বেতনও বাড়াতে হবে। যদিও এই বিষয়ে সরকারের সরাসরি সিদ্ধান্ত দেওয়ার সুযোগ নেই, তবু প্রণোদনা দিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলোকে উৎসাহিত করা যেতে পারে। পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি কমিয়ে জীবনযাত্রা সহনীয় করা জরুরি। সে জন্য মুদ্রানীতি, রাজস্ব নীতি ও বাজার ব্যবস্থাপনার মধ্যে সমন্বয় প্রয়োজন।
সবচেয়ে বড় কথা সরকার প্রয়োজনে সরাসরি বাজারে হস্তক্ষেপ করতে পারে। এতে কোনো সমস্যা নেই। উন্নত দেশেও প্রয়োজন হলে রেশনিং ব্যবস্থা চালু হয়। কিন্তু আমাদের দেশে টিসিবি বা খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কয়েকটি ট্রাক বিক্রির বাইরে তেমন ব্যবস্থা নেই। মানুষের জীবনমান উন্নত না হলে গণতন্ত্র বা নতুন কোনো ব্যবস্থা টিকে না। কেননা মানুষ সর্বদা বাস্তব পরিবর্তন দেখতে চায়। সূত্র: প্রথম আলো

