বাংলাদেশ সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ধরে রাখতে এবং কাঠামোগত সংস্কারে কিছু অগ্রগতি অর্জন করলেও, দুর্বল রাজস্ব আহরণ, আর্থিক খাতের ঝুঁকি ও উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে বড় ধরনের ম্যাক্রো-ফাইন্যান্সিয়াল চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে। এমন সতর্কতা দিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)।
গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সংস্থাটি তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে এ পর্যবেক্ষণ জানায়। এটি এসেছে বাংলাদেশে আইএমএফের ১৩ দিনের পর্যালোচনা মিশন শেষে, যা ২৯ অক্টোবর থেকে ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয়। মিশনের নেতৃত্ব দেন ক্রিস পাপাজর্জিও।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, রাজস্ব ও আর্থিক খাতের দুর্বলতা মোকাবিলায় সাহসী ও কার্যকর নীতি নেওয়া এখন জরুরি। এ ধরনের পদক্ষেপের মাধ্যমে টেকসই স্থিতিশীলতা বজায় রেখে শক্তিশালী ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি পুনরুদ্ধার করা সম্ভব। নীতি গ্রহণে বিলম্ব বা দুর্বল পদক্ষেপ নেওয়া হলে অর্থনীতি নতুন ঝুঁকিতে পড়বে বলে সতর্ক করেছে সংস্থাটি।
মূল্যস্ফীতি এখনও উচ্চ:
আইএমএফের মূল্যায়ন অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে ৩.৭ শতাংশে নেমেছে। এর পেছনে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার প্রভাব রয়েছে। অন্যদিকে, মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্ক থেকে ৮ শতাংশে নেমেছে, তবু এখনও তুলনামূলকভাবে উচ্চ।
মিশন প্রধান ক্রিস পাপাজর্জিও বলেন, “বাহ্যিক ভারসাম্য রক্ষা ও মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকার রাজস্ব ও আর্থিক নীতিতে কঠোরতা এনেছে। মে মাসে বিনিময় হার সংস্কার শুরু হওয়ার পর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পুনর্গঠনের ধারা শুরু হয়েছে।” তবে তিনি সতর্ক করে বলেন, “দুর্বল কর আদায় ও ব্যাংক খাতের মূলধন ঘাটতি বাংলাদেশের জন্য এখনও বড় ঝুঁকি।”
সংস্কার বিলম্বে নতুন ঝুঁকি:
আইএমএফ জানায়, রাজস্ব ও ব্যাংক খাতে সংস্কার বিলম্বিত হলে প্রবৃদ্ধি আরও কমবে, মূল্যস্ফীতি বাড়বে এবং সামষ্টিক স্থিতিশীলতা বিঘ্নিত হবে। সংস্থার পূর্বাভাস অনুযায়ী, দৃঢ় সংস্কার বাস্তবায়ন করা গেলে ২০২৫-২৬ ও ২০২৬-২৭ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি প্রায় ৫ শতাংশে উন্নীত হতে পারে। ২০২৬-২৭ অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি ৫.৫ শতাংশে নেমে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে, যদিও ২০২৬ সালে তা ৮.৮ শতাংশে থাকতে পারে।
রাজস্ব সংস্কারের সুপারিশ:
আইএমএফ বলেছে, সামাজিক খাতে ব্যয় ও অবকাঠামো বিনিয়োগ বাড়াতে উচ্চাভিলাষী কর সংস্কার অপরিহার্য। প্রস্তাব করা হয়েছে— হ্রাসকৃত ভ্যাট হার বাতিল, অপ্রয়োজনীয় কর অব্যাহতি প্রত্যাহার (অপরিহার্য পণ্য-সেবা ছাড়া), সব প্রতিষ্ঠানের জন্য সর্বনিম্ন টার্নওভার করহার বৃদ্ধি এবং কর প্রশাসনকে আরও কার্যকর ও স্বচ্ছ করা।
ব্যাংক খাত সংস্কারের আহ্বান:
দুর্বল ব্যাংকগুলোর সমস্যার সমাধানে আইএমএফ একটি সমন্বিত সরকারি কৌশল প্রস্তাব করেছে। এতে অন্তর্ভুক্ত থাকবে— মূলধন ঘাটতি পূরণ, সরকারি সহায়তা, আইনি কাঠামোর সংস্কার এবং অর্থের উৎস নির্ধারণ। একই সঙ্গে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের সম্পদমান পর্যালোচনা, ব্যাংক পরিচালনা ও স্বচ্ছতা উন্নয়ন এবং খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া শক্তিশালী করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
দীর্ঘমেয়াদি কাঠামোগত সংস্কারের প্রয়োজন:
আইএমএফ আরও বলেছে, মধ্যমেয়াদে শাসনব্যবস্থা শক্তিশালী করা, যুব বেকারত্ব হ্রাস এবং অর্থনৈতিক বহুমুখীকরণ ত্বরান্বিত করতে ব্যাপক কাঠামোগত সংস্কার জরুরি। এসব উদ্যোগ বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা বাড়াবে এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন নিশ্চিত করবে।

