বিশ্বজুড়ে সাশ্রয়ী ও তুলনামূলক নিরাপদ গণপরিবহন হিসেবে ট্রেনের জনপ্রিয়তা অনেক বেশি। বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ দেশে রেল শুধু যাতায়াত নয়, মাল পরিবহন ও কর্মসংস্থানের গুরুত্বপূর্ণ খাত। সময়ের সঙ্গে রেলের পরিসর বেড়েছে, হয়েছে বড় বিনিয়োগ। তারপরও রেলওয়ের সেবার মান আশানুরূপ পর্যায়ে উঠতে পারেনি।
যাত্রীরা সাধারণত সহজে টিকিট পাওয়া, পরিচ্ছন্ন প্ল্যাটফর্ম ও ট্রেন, স্বাচ্ছন্দ্যময় যাত্রার প্রত্যাশা করেন। কিন্তু এসব মৌলিক সেবা এখনো নিশ্চিত হয়নি। কোনো সরকারই তা করতে পারেনি। অন্তর্বর্তী সরকারও ব্যর্থ হয়েছে। অথচ এসব সমস্যা সমাধানে বড় বিনিয়োগ বা দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন ছিল না। দক্ষ ব্যবস্থাপনা থাকলেই সেবার মান অনেকটা বাড়ানো যেত।
কমলাপুরে ভোগান্তির চিত্র:
সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা গেছে, দেশের ব্যস্ততম কমলাপুর স্টেশনে পর্যাপ্ত বিশ্রামাগার নেই। যাত্রীদের বেশির ভাগ সময় প্ল্যাটফর্মেই অপেক্ষা করতে হয়। অনেক সময় ফ্যান বন্ধ থাকে। টয়লেট কম এবং যেগুলো আছে তার বেশির ভাগই অপরিচ্ছন্ন। ফ্রি পানির ব্যবস্থা থাকলেও সেখানেও পরিচ্ছন্নতার ঘাটতি। স্টেশনজুড়ে ভবঘুরেদের আনাগোনা, চুরি-ছিনতাই তো নিত্যদিনের ঘটনা। দেশের প্রধান স্টেশনের এমন অবস্থা অন্য স্টেশনগুলোর দুরবস্থার ইঙ্গিতই দেয়।
বিনা টিকিটে ভ্রমণ থামেনি:
এখনো বিনা টিকিটে ট্রেনযাত্রা পুরোপুরি বন্ধ করা যায়নি। বগিতে সিটের চেয়ে বেশি মানুষ ওঠে। এতে সিটধারী যাত্রীরাও সমস্যায় পড়েন। ঈদে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরও পরিবর্তন আসেনি। রেল কর্তৃপক্ষ সেবার মান বাড়াতে ব্যর্থ হয়েছে, অথচ রেল বহু বছর ধরেই লোকসানে চলছে। এর প্রধান কারণও অদক্ষ ব্যবস্থাপনা।
ইঞ্জিন–জনবল–রক্ষণাবেক্ষণে ঘাটতি:
নতুন রেলপথ নির্মাণ ও ট্র্যাক সংস্কারে নানা প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হলেও চাহিদামতো ইঞ্জিন আমদানি করা হয় না। প্রয়োজনীয় জনবলও নিয়োগ দেওয়া হয় না। ইদানীং ট্রেন দুর্ঘটনা বেড়েছে। চলন্ত অবস্থায় ইঞ্জিন-বগি বিচ্ছিন্ন হওয়া, ঘন ঘন লাইনচ্যুতি—এসব কারিগরি ত্রুটি নিয়মিত ঘটছে। টিকিট কালোবাজারি তো সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুর্বল ব্যবস্থাপনার ফলে ট্রেনে অপরিচ্ছন্নতা, ট্রেনলেট হওয়া, আসনবিহীন ও টিকিটবিহীন যাত্রী, খাবারের বাড়তি দামসহ নানা সমস্যা দেখা দেয়।
দুর্নীতি বড় বাধা:
রেলের দুরবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ দুর্নীতি। দুদক সম্পত্তি ইজারা, অবৈধ স্থাপনা, কেনাকাটা, ভূমি অধিগ্রহণ, যন্ত্রাংশ নিলাম, টিকিট বিক্রি, ট্রেন ইজারা, ক্যাটারিং—এসব খাতে অসংখ্য অনিয়ম পেয়েছে। ২০০৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ৮৩টি প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে ২০ হাজার ৬৬৬ কোটি টাকা। তারপরও ২০২০-২১ অর্থবছরে রেল ২ হাজার ১০২ কোটি টাকা লোকসান করে—যা ‘বাংলাদেশ ইকোনমিক রিভিউ ২০২৩’-এ উল্লেখ আছে। অর্থাৎ বিপুল বিনিয়োগ হলেও সেবার মান বাড়েনি, বরং অব্যবস্থাপনা আরও স্পষ্ট হয়েছে। বর্তমানে রেল পরিচালনায় বছরে ৪ হাজার কোটি টাকার বেশি খরচ হয়। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, অনবোর্ড সেবা, ইঞ্জিন–কোচ মেরামত, রক্ষণাবেক্ষণ ও যন্ত্রাংশ কেনাকাটায় বড় অংকের ব্যয় হলেও দক্ষতার অভাবে কাঙ্ক্ষিত উন্নতি হচ্ছে না।
কর্মীদের দায়িত্বহীনতা ও সম্পদের সংকট:
রক্ষণাবেক্ষণ-সংশ্লিষ্ট কর্মীদের দায়িত্বহীনতাও সেবার উন্নয়নে বড় বাধা। রেলপথ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা বণিক বার্তাকে জানান, কর্মীদের মানসিকতা ও দায়িত্ববোধ দুর্বল। পাশাপাশি রেলসেবার মান বাড়ানোর মতো পর্যাপ্ত ইঞ্জিন ও কোচও নেই। চলতি বছরের মার্চে কমলাপুরে নতুন কমিউটার ট্রেনের উদ্বোধনে তিনি রেলের লোকসান বাড়ার পেছনে দুর্নীতি ও অপচয়কে সবচেয়ে বড় কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা দূর করতে পারলে সেবার মান বাড়বে এবং ব্যয়–আয়ের ব্যবধানও কমবে। বিদ্যমান সম্পদের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে রেলকে লাভজনক করা সম্ভব। এজন্য শক্তিশালী নজরদারি ও কার্যকর পদক্ষেপ জরুরি।
যাত্রীরা অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে উদ্যোগ আশা করেছিল কিন্তু সরকার প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। প্রকল্প ব্যয় কিছুটা কমানো গেলেও লোকসান কমেনি। রেলপথ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫-২৬ অর্থবছরে পরিচালন ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ হাজার ২২৯ কোটি টাকা। এর বিপরীতে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ৩ হাজার ১৭৩ কোটি টাকা। কিন্তু বাংলাদেশ রেলওয়ে জানিয়েছে, এই লক্ষ্য অর্জন সম্ভব না। এই পরিস্থিতিতে নির্বাচিত নতুন সরকার ও রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ সেবার মানোন্নয়ন ও রেলকে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরকে অগ্রাধিকার দেবে—যাত্রীদের এখন সেই প্রত্যাশাই বাড়ছে।

