এখন থেকে পাঁচ বছরের পরিবর্তে তিন বছর পরপর বিভিন্ন খাতের শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি বাড়বে। এর ফলে তৈরি পোশাক, চা–বাগান, বেসরকারি পাটকলসহ ১৩টি খাতে আগামী বছরের মধ্যেই নতুন মজুরি কাঠামো নির্ধারণ করতে হবে। এসব খাতের সর্বশেষ মজুরি কাঠামো কার্যকর হয়েছে তিন বছর আগে বা আগামী বছরে তিন বছর পূর্ণ হবে।
শ্রমিকনেতারা বলছেন, শ্রমিকের জীবনমান উন্নয়নে তিন বছর অন্তর মজুরি মূল্যায়নের দাবি অনেক দিনের। শ্রম আইন সংশোধনের অধ্যাদেশে এই দাবি অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় মূল্যস্ফীতির চাপের মধ্যে শ্রমিকরা কিছুটা হলেও স্বস্তি পাবেন। অন্যদিকে মালিকপক্ষ মনে করে, প্রতিবার নতুন মজুরি নির্ধারণের সময়, বিশেষ করে পোশাক খাতে, শ্রম অস্থিরতা দেখা দেয়। একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকলে এসব অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি কমবে।
গত সোমবার শ্রম আইন সংশোধনের অধ্যাদেশ জারি করে সরকার। এর আগে শ্রম সংস্কার কমিশন তিন বছর পরপর মজুরি মূল্যায়নের সুপারিশ করে। কমিশন বলে, মজুরি নির্ধারণের সময় শ্রমিককে পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ধরে এমন কাঠামো করতে হবে, যাতে পরিবার চালানো সম্ভব হয়। তবে এই বিষয়টি অধ্যাদেশে উল্লেখ নেই।
ইন্ডাস্ট্রিঅল বাংলাদেশ কাউন্সিলের সাবেক মহাসচিব সালাউদ্দিন স্বপন বলেন, তিন বছর অন্তর মজুরি পুনর্নির্ধারণ ইতিবাচক পদক্ষেপ। কিন্তু মজুরিকাঠামো কী হবে এবং মজুরি বোর্ডে শ্রমিক প্রতিনিধি কে হবেন—এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আগের কয়েকটি বোর্ডে মালিকপক্ষের পছন্দের শ্রমিকনেতাকে মনোনীত করা হয়েছে। এটি বন্ধে শ্রম বিধিমালায় স্পষ্ট নিয়ম প্রয়োজন। না হলে শ্রমিকরা আইনের পুরো সুফল পাবে না।
নিম্নতম মজুরি বোর্ড এখন পর্যন্ত ৪২টি খাতের ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করেছে। বর্তমানে তিনটি নতুন খাতসহ ১৭টি খাতের মজুরি পুনর্নির্ধারণ চলছে। ছয়টি খাতের সময়সীমা ইতিমধ্যে পেরিয়েছে। তবে ১৩টি খাতের মজুরি এই বছর বা আগামী বছরের শুরুতেই নতুন করে নির্ধারণ করতে হবে। আগের নিয়ম অনুযায়ী ৫ বছর পর মূল্যায়ন করলে এসব খাতে মজুরি পুনর্নির্ধারণ আরও দেরিতে হতো।
মজুরি পুনর্নির্ধারণে যেসব ১৩টি খাত রয়েছে—নিরাপত্তাকর্মী সেবা, স মিলস, প্রিন্টিং প্রেস, চিংড়ি, মাছ শিকারি ট্রলার, রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ, ব্যক্তিমালিকানাধীন পাটকল, হোমিওপ্যাথ কারখানা, বিড়ি, চা–বাগান, সিনেমা হল, হোসিয়ারি এবং তৈরি পোশাকশিল্প। শুধু পোশাক খাতেই শ্রমিকের সংখ্যা ৪০ লাখ।
বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, তিন বছর অন্তর মজুরি বাড়লে শ্রমিকের জীবনমান উন্নত হবে। তবে এর জন্য ক্রেতাদের ন্যায্য দাম দিতে হবে। না হলে অনেক কারখানা বন্ধ হওয়ার ঝুঁকিতে পড়তে পারে। তিনি বলেন, মজুরি নির্ধারণের সময় অস্থিরতা তৈরি হয়। তাই একটি গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি জরুরি।
তৈরি পোশাক খাতের সর্বশেষ মজুরি কাঠামো ২০২৩ সালের ১ ডিসেম্বর কার্যকর হয়। ওই সময়ে শ্রমিক আন্দোলনে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। চার শ্রমিক নিহত হন। অনেক শ্রমিকের বিরুদ্ধে মামলা হয়। শেষ পর্যন্ত ন্যূনতম মজুরি ৮ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ১২ হাজার ৫০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। যদিও এই মজুরি এখনো অনেক রপ্তানিকারক দেশের তুলনায় কম।
শ্রম সংস্কার কমিশনের সাবেক প্রধান সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ বলেন, তিন বছর অন্তর মজুরি মূল্যায়ন স্বাগতযোগ্য। তবে একটি মানদণ্ড নির্ধারণ করা প্রয়োজন ছিল। আইন অনুযায়ী জীবনযাত্রার ব্যয় বিবেচনায় মজুরি নির্ধারণের বিধান থাকলেও শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক বিবেচনায় সিদ্ধান্ত হয়। অথচ বাংলাদেশ ব্যাংক, বিবিএসসহ বিভিন্ন সংস্থার তথ্যভিত্তিক বিশ্লেষণের ওপর ভিত্তি করে মজুরি নির্ধারণ হওয়া উচিত।
তিনি আরও বলেন, শ্রমিকের মজুরি নির্ধারণে প্রচলিত ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। নাগরিকের মর্যাদা ও উৎপাদন প্রক্রিয়ায় শ্রমিকের ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিত করে তবেই মর্যাদাপূর্ণ জীবন নিশ্চিত করা সম্ভব। এতে সামাজিক ন্যায়বিচারও এগিয়ে যাবে।

