যুক্তরাষ্ট্রের বাড়তি শুল্ক আরোপ, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের ঋণ না ছাড়ার সিদ্ধান্ত, ডলারের উচ্চমূল্য এবং ভূরাজনীতির টানাপোড়েনের প্রভাবে দেশের অর্থনীতি চাপে আছে। এ পরিস্থিতিতে দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা আরও বাড়িয়েছে ব্যবসা-বাণিজ্যের চাপ।
নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘সম্প্রতি দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা বেড়েছে। এর মারাত্মক প্রভাব পড়েছে ব্যবসায়। বিভিন্ন স্থানে নাশকতার খবর ইতিমধ্যে দেশ-বিদেশের মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে। বিমান বন্দরের কার্গো ভিলেজে আগুন লাগার ঘটনাও আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় এসেছে। এসব কারণে দেশের ব্যবসায় স্থিতিশীলতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে অনেক বিদেশি অর্ডার বাতিল হয়ে গেছে। ক্রেতারা পণ্যের সরবরাহ নিশ্চয়তা ছাড়া নতুন অর্ডার দিতে আগ্রহী হচ্ছেন না। তারা আশঙ্কা করছেন আমরা সময়মতো পণ্য সরবরাহ করতে পারব কি না। এই কারণে আগে দেওয়া অনেক অর্ডার বাতিল হয়েছে। একটি গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে এই অস্থিরতার সমাধান হবে বলে আশা করছি।’
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি তাসকীন আহমেদ বলেন, ‘দেশের ব্যবসায়িক অঙ্গন এখন সবচেয়ে সংকটময় অবস্থার মধ্যে রয়েছে। রাজনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা, মূল্যস্ফীতি, জ্বালানিসংকট, উচ্চ সুদের হার এবং উৎপাদন ব্যয়ের বৃদ্ধি ব্যবসার পরিবেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। নতুন বিনিয়োগও স্থবির হয়ে পড়েছে। এলডিসি থেকে উত্তরণের চ্যালেঞ্জসহ এই অর্থনৈতিক দুরবস্থায় ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ সব ধরনের ব্যবসা মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হচ্ছে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি করাও কঠিন হয়ে পড়েছে।
তিনি আরও বলেন, ‘সরকার গুরুত্বপূর্ণ নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে পরামর্শ করে না। তাই সরকারের সঙ্গে আমাদের দূরত্ব বাড়ছে। এই নাজুক পরিস্থিতিতে বলতে চাই, ব্যবসায়ীদের কথা বলার আর ক্ষমতা নেই, আল্লাহর হাতে ছেড়ে দিয়েছি। কারণ আল্লাহ ছাড়া আমাদের কথা শোনার কেউ নেই। রাজনৈতিক অস্থিরতা কাটিয়ে এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে হলে সব দলের ঐকমত্যে অবাধ, সুষ্ঠু ও সহিংসতামুক্ত নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবি করছি।’
উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ইতিমধ্যে দেশের অর্থনীতিতে রাজনৈতিক অস্থিরতার নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছে। সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে স্বল্পমেয়াদি ভালো সম্ভাবনা ছিল।’ সাম্প্রতিক সময়ে দেশটিতে রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দেওয়ায় স্বল্পমেয়াদি অর্থনৈতিক সম্ভাবনায় নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এর প্রভাব আগামীতে আরও দৃশ্যমান হবে। জিডিপি প্রবৃদ্ধির হারও কমে আসছে। অর্থনীতির বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছাড়া টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগে আস্থা পাচ্ছেন না।
রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে রাজস্ব ঘাটতিও বাড়ছে। অনেক ব্যবসায়ী জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) রাজস্ব পরিশোধের সময় বাড়ানোর আবেদন করেছেন। ব্যবসায়ীদের বেশির ভাগ আবেদনে বলা হয়েছে, রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য ভালো যাচ্ছে না। দোকানপাট বন্ধ রাখতে হচ্ছে, বিক্রি কমেছে, কারখানায় বেচাকেনাও কমেছে। ফলে নিয়মিত ভ্যাট ও শুল্ক পরিশোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে রাজস্ব পরিশোধের সময় বাড়ানো প্রয়োজন।
দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই’র সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, ‘বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিনিয়োগকারীরা অপেক্ষার নীতি নিয়েছেন। তারা দেখছেন রাজনৈতিক পরিস্থিতি কোন দিকে যায়। অস্থিরতা বাড়ায় তারা আরও সতর্ক হয়ে উঠেছেন। এই অনিশ্চয়তার কারণে নতুন শিল্প শুরু হচ্ছে না, পুরোনো শিল্পও ঝুঁকির মুখে পড়েছে। ফলে নতুন কর্মসংস্থানও সৃষ্টি হচ্ছে না। এই পরিস্থিতি কাটানোর জন্য গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের বিকল্প নেই।’ তিনি আরও বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করতে না পারলে রাজস্ব পরিশোধ কিভাবে করবেন? বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহও কমেছে। বিনিয়োগ না থাকলে দেশের অর্থনীতিতে স্থবিরতা বাড়বে। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বেসরকারি খাত বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে।’
ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক মুস্তফা কে. মুজেরী বলেন, ‘সরকার আর্থিক সংকটে আছে। ব্যাংক খাত, বিনিয়োগ, প্রকল্প উন্নয়ন, পুঁজিবাজারসহ অর্থনীতির প্রায় সব খাতেই ভারসাম্য কমছে। বিনিয়োগ অর্থনীতির জ্বালানি। রাজনৈতিক অস্থিরতায় বিনিয়োগ নেই বললেই চলে। ফলে অর্থনীতিতে ভারসাম্য আরও নষ্ট হচ্ছে। এই অবস্থা কাটিয়ে উঠতে হলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনা জরুরি।’
রাজনৈতিক অস্থিরতার বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে পর্যটন খাতে। প্রতিবছর অক্টোবর থেকে মার্চকে পর্যটন মৌসুম ধরা হয়। এই সময়ে পর্যটন সংশ্লিষ্ট খাতে ব্যাপক প্রস্তুতি থাকে এবং বড় বিনিয়োগ করা হয়। কক্সবাজার, কুয়াকাটা ও সেন্ট মার্টিনের মতো জনপ্রিয় স্থানগুলোতে পর্যটকের ভিড় কম। অনেকে হোটেল ও রিসোর্টে অগ্রিম বুকিং বাতিল করেছেন। এতে কোটি কোটি টাকার ক্ষতির মুখে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। ট্যুর অপারেটস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (টোয়াব) সভাপতি মোহাম্মদ রাফিউজ্জামান বলেন, ‘অক্টোবর-নভেম্বরে পর্যটকের সংখ্যা বেশি থাকে। তারা নিরাপদে ও নিশ্চিন্তে ঘুরতে চান। কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে এবার পর্যটক কম। আশা করি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে। পর্যটন খাত আবার চাঙা হবে।’
খোঁজে জানা গেছে, কক্সবাজার শহর ও আশপাশের পর্যটন এলাকায় ৫ শতাধিক হোটেল, মোটেল, রেস্ট হাউস ও রিসোর্ট আছে। এতে প্রায় ১ লাখ ৭০ হাজার পর্যটক থাকার সুবিধা রয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে অনেক পর্যটক শহর ছেড়েছেন এবং অগ্রিম বুকিং বাতিল করেছেন।
আবাসন খাতেও প্রভাব পড়েছে। দেশের আবাসন খাতের বাজার প্রায় দুই লাখ কোটি টাকার। এই খাতের ওপর ২০০-এর বেশি অন্যান্য শিল্প নির্ভরশীল। আবাসন খাতের সংগঠন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) ঊর্ধ্বতন সহসভাপতি লিয়াকত আলী ভূঁইয়া বলেন, ‘রিহ্যাবের ৮৯৪টি সদস্য কোম্পানি আছে। এর বাইরে আরও অনেক কোম্পানি সারা দেশে ছড়িয়ে আছে। সম্প্রতি রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে আবাসন খাতের প্লট ও ফ্ল্যাট বিক্রি কমেছে। বহুদিন ধরে চলা মূল্যস্ফীতি সাধারণ মানুষের অর্থ কমিয়ে দিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যের অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে।’

