বাংলাদেশের জ্বালানি খাত এখন গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে রয়েছে। খাতটিকে স্থিতিশীল করতে এবং টেকসই বেসরকারি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে দ্রুত পদক্ষেপ দরকার। টেকসই প্রবৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য এটি জরুরি। নাহলে সংকট দীর্ঘায়িত হবে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ব্যবসায়িক নেতারা এই আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। গতকাল বুধবার (১৯ নভেম্বর) ‘পাওয়ারিং প্রসপারিটি: ক্রিয়েটিং এ স্টেবল অ্যান্ড ব্যাঙ্ক্যাবল এনার্জি ফিউচার ফর বাংলাদেশ’ শীর্ষক বিদ্যুৎ খাত নীতি সংলাপে এই হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়। পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশ ও ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম যৌথভাবে অনুষ্ঠানটি আয়োজন করে।
প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের চেয়ারম্যান জালাল আহমেদ। আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন কোরিয়া প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রদূত পার্ক ইয়ুং-সিক, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল আউয়াল মিন্টু, জামায়াতে ইসলামীর শুরা কাউন্সিলের সদস্য ড. মোবারক হোসেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা ড. মাহদী আমিন, বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান, এমসিসিআই সভাপতি কামরান টি রহমান, ডিএফডিএলের শাহীন নিজাম, বিডার মহাপরিচালক মো. আরিফ হোসেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের অতিরিক্ত পরিচালক আহমেদ জুবাইর মাহমুদ, ইবিএলের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক আহমেদ শাহীন, আইডিএসওএলের প্রধান বিনিয়োগ কর্মকর্তা নাজমুল হক, কনফিডেন্স পাওয়ার রংপুর লিমিটেডের চেয়ারম্যান ইমরান করিম প্রমুখ।
আলোচকরা বলেন, সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নীতি পরিবর্তন বিদেশি বিনিয়োগকে প্রভাবিত করছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে টেকসই বিদেশি বিনিয়োগের জন্য দীর্ঘমেয়াদি নীতি গ্রহণ জরুরি। প্যানেল আলোচনায় ইনডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের অধ্যাপক ও উপাচার্য ড. এম তামিম সতর্ক করেন, জ্বালানি খাতের জন্য টেকসই এবং বাস্তবসম্মত পরিকল্পনার অভাব আগামী সরকারকে বড় ধরনের সংকটে ফেলে দেবে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদন পরিকল্পনাকে তিনি আমলাতান্ত্রিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা হিসেবে সমালোচনা করেন। মাঠ পর্যায়ে এর কোনো বাস্তবায়ন নেই। ড. তামিম বলেন, বাপেক্সের সক্ষমতার সীমাবদ্ধতার কারণে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন বাড়ানোর জন্য সক্ষম আন্তর্জাতিক কোম্পানির সহায়তা নিতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা সক্ষমতা ও চাহিদার ব্যবধানকে সংকটের মূল কারণ হিসেবে তুলে ধরেন। বাংলাদেশ ২০০৯ সালের সাড়ে ৩ হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতা থেকে ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ২৮ হাজার ৩৫৯ মেগাওয়াট সক্ষমতায় পৌঁছালেও কাঠামোগত চ্যালেঞ্জ এই অগ্রগতিকে হুমকির মুখে ফেলছে। ইএমএ পাওয়ার ইনভেস্টমেন্টের পরিচালক আবু চৌধুরী বিদ্যুৎ খাতের সমস্যা ও উন্নয়নের অবস্থা নিয়ে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, আসন্ন সরবরাহ-চাহিদার ভারসাম্যহীনতা এবং সীমিত নতুন বিনিয়োগ থাকলে উল্লেখযোগ্য বিদ্যুৎসংকট অনিবার্য হয়ে উঠবে।
বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা হ্রাসের আশঙ্কা:
বাংলাদেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২০২৯ সালে প্রায় ৩৫ হাজার মেগাওয়াটে পৌঁছানোর সম্ভাবনা থাকলেও ২০৩৫-৪০ সালের মধ্যে তা কমে প্রায় ৩০ হাজার মেগাওয়াটে নেমে যাবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর প্রধান কারণ হলো পুরোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হওয়া, গ্যাস সরবরাহের হ্রাস এবং নতুন প্রকল্প যুক্ত না হওয়া। এই পরিস্থিতি বিদ্যুৎ খাতে সরবরাহ চাহিদার ভারসাম্য নষ্ট করতে পারে এবং বেসরকারি বিনিয়োগ ও নতুন প্রকল্পের উন্নয়নে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। দ্রুত নীতি সংস্কার এবং নতুন উৎপাদন প্রকল্প গ্রহণ না হলে আগামী দশকে দেশের বিদ্যুৎ খাত সংকটের মুখে পড়বে।
বিদ্যুতের চাহিদা বৃদ্ধি:
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি দেশের বিদ্যুতের চাহিদা বছরে ৬ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পায়, তবে ২০৩৩ সালের প্রথম দিকে চাহিদা বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতাকে ছাড়িয়ে যাবে। ২০৪০ সালের মধ্যে চাহিদা প্রায় ৪০ হাজার ৯০০ মেগাওয়াটে পৌঁছাবে। ‘অতিরিক্ত সক্ষমতা’ ধারণা বিভ্রান্তিকর। কারণ ২০৩২ সালের পর কার্যকর উৎপাদন চাহিদার পিকের নিচে নেমে যাবে। ২০৪০ সালে কার্যকর উৎপাদন মাত্র ২০ হাজার ৯০১ মেগাওয়াট, ফলে প্রায় ১৪ হাজার ৬৪৯ মেগাওয়াট ঘাটতি তৈরি হবে। বিদ্যুৎ খাতে বেসরকারি বিনিয়োগকে প্রভাবিত করছে কিছু মূল চ্যালেঞ্জ। প্যানেলিস্টরা বলেন, বিদ্যুৎব্যবস্থার চাপ এবং নীতির অস্থিরতা বেসরকারি মূলধনকে নিরুৎসাহিত করছে। বর্তমানে দেশের প্রায় ৪৮ শতাংশ ইনস্টলড সক্ষমতা বেসরকারি খাত সরবরাহ করছে।
বিপিডিবির আর্থিক সংকট বিদ্যুৎ খাতের বিনিয়োগে বাধা:
বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ডের (বিপিডিবি) ৩০ হাজার কোটি টাকারও বেশি বকেয়া বিল রয়েছে। এর ফলে বিপিডিবি নির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎ ক্রেতা হিসেবে আস্থা হারাচ্ছে এবং নতুন বিদেশি বিনিয়োগে বাধা তৈরি হচ্ছে। এছাড়াও বিপিডিবি, আইপিপি এবং গ্যাস সরবরাহকারীদের মধ্যে ৪২ হাজার কোটি টাকার বকেয়া ঋণ বিদ্যুৎ খাতের তারল্যকে হুমকির মুখে ফেলেছে। ক্রমবর্ধমান এই সার্কুলার ঋণ খাতের সুস্থ বিনিয়োগ পরিবেশের জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে।
নীতিমালার অস্থিরতা ও গ্যারান্টি প্রত্যাহার:
বিদ্যুৎ খাতে ঘন ঘন নীতি পরিবর্তন এবং ৩১টি নবায়নযোগ্য প্রকল্প বাতিল হওয়ার কারণে বিনিয়োগকারীদের আস্থা নষ্ট হয়েছে। এর ফলে ক্লিন এনার্জি খাতে বিনিয়োগের গতি বিলম্বিত হয়েছে। এছাড়াও সরকার-সমর্থিত সার্বভৌম গ্যারান্টি প্রত্যাহার করায় বিনিয়োগ ঝুঁকি ও অর্থায়নের ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। এটি বিদ্যুৎ খাতে নতুন বিনিয়োগকে কম লাভজনক করেছে এবং বেসরকারি বিনিয়োগকে সীমিত করছে।
ভর্তুকি চাপ ও জ্বালানি আমদানির ওপর নির্ভরশীলতা:
বিদ্যুৎ খাতে ১ দশমিক ৩৯ ট্রিলিয়ন টাকা এবং গ্যাস খাতে ৬৮০ বিলিয়ন টাকার বাড়তি ভর্তুকি সরকারের অর্থায়নে বড় চাপ সৃষ্টি করছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ভর্তুকি বৃদ্ধির কারণে খাতের দীর্ঘমেয়াদি টেকসইতা হুমকির মুখে। বিদ্যুৎ খাতের ৬৫ শতাংশেরও বেশি জ্বালানি আমদানি করা হয়। এর ফলে বিশ্ববাজারে দামের ওঠানামার জন্য খাতটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে, অভ্যন্তরীণ গ্যাস অনুসন্ধান ধীরগতিতে চলছে।
বিশেষজ্ঞরা নীতি সংস্কার এবং ক্লিন এনার্জি সম্প্রসারণের ওপর জোর দিচ্ছেন। বিদ্যুৎ খাতের ৪৩ শতাংশ প্রাকৃতিক গ্যাসের ওপর নির্ভরশীলতা দ্রুত পরিবর্তিত হতে চলেছে। ২০৩৩-৩৫ সালের মধ্যে দেশীয় গ্যাসের তীব্র হ্রাসের কারণে হেভি ফুয়েল অয়েল উৎপাদনের ৩৩-৪৫ শতাংশ হয়ে উঠতে পারে। স্থিতিশীল এবং ব্যাংকযোগ্য ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে নীতিগত সমন্বয় অপরিহার্য বলে তারা বলছেন।
নীতির প্রভাব ও ক্লিন এনার্জি বিলম্ব:
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংকট এড়াতে গ্যাস, নবায়নযোগ্য জ্বালানি এবং দক্ষতার উন্নয়ন অপরিহার্য। শুধু ইনস্টলড সক্ষমতার পরিসংখ্যান ব্যবহার করলে বাস্তবে প্রস্তুত থাকার মিথ্যা ধারণা তৈরি হয়। নীতি পরিবর্তন এবং বিনিয়োগ বিলম্বের কারণে ক্লিন এনার্জি লক্ষ্য অর্জনে বাধা তৈরি হচ্ছে। ২০৩০ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানির লক্ষ্য ২০ শতাংশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ৩০ শতাংশ অর্জনের পথে হুমকি দেখা দিয়েছে।
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের চেয়ারম্যান জালাল আহমেদ ব্যবসায়ীদের উদ্দেশ্যে বলেন, “রেগুলেটরি কমিশন সবকিছু স্বচ্ছতার সঙ্গে নিয়ন্ত্রণ করছে। জ্বালানিসংক্রান্ত যেকোনো সমস্যা সমাধানে আপনার জন্য দুয়ার খোলা। যেকোনো পরামর্শ আমলে নেওয়া হবে এবং সমস্যা সমাধান করা হবে।

