বিশ্ববাজারে চাল ও গমের দাম কমলেও তার সুফল এখনও দেশের ভোক্তাদের হাতে পৌঁছায়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়লে ব্যবসায়ীরা সঙ্গে সঙ্গে দেশের বাজারে দাম বাড়িয়ে দেন কিন্তু দাম কমলে সুবিধা পৌঁছাতে সময় লাগে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত এক বছর ধরে আন্তর্জাতিক বাজারে চাল ও গমের দাম ধারাবাহিকভাবে কমেছে। তবুও বাংলাদেশের বাজারে এই দুটি নিত্যপণ্যের দাম উল্টো বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশের গমের চাহিদার সিংহভাগই আমদানির মাধ্যমে পূরণ হয়। সরকারি ও বেসরকারি খাত যথেষ্ট চালও আমদানি করেছে। তবুও বিশ্ববাজারে দাম কমার সুবিধা দেশের ভোক্তারা পাচ্ছেন না। বিশেষজ্ঞরা জানান, দাম বাড়লে ব্যবসায়ীরা সঙ্গে সঙ্গে দাম বাড়িয়ে দেন। কিন্তু দাম কমলে তার সুফল পৌঁছাতে সময় লাগে।
করোনা মহামারির সময় বিশ্বজুড়ে সরবরাহ ব্যবস্থা ব্যাহত হওয়ার কারণে খাদ্যের দাম বেড়ে গিয়েছিল। ২০২১ সালে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দাম কিছুটা কমে আসে। তবে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে বিশ্ববাজারে গম ও অন্যান্য পণ্যের দাম আবারও বাড়ে। ওই সময়ে ব্যবসায়ীরা গম থেকে তৈরি রুটি, বিস্কুট, কেক, টোস্ট ও ওয়েফারের আকার ও ওজন ছোট করে দেন। পাস্তা ও নুডলসের প্যাকেটের পরিমাণ কমানো হয়। হোটেলগুলোও রুটি, নান, পরোটা, সিঙ্গাড়ার আকার ছোট করে দাম বাড়িয়ে দেয়। সেই অতিরিক্ত দাম এখনও চলমান।
খাদ্য সচিব মো. মাসুদুল হাসান বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে বাংলাদেশের বাজারের চাল ও গম বা আটার দামের সামঞ্জস্য না থাকার বিষয়ে কোনো সরকারি গবেষণা নেই। তাই আনুষ্ঠানিক মন্তব্য করা কঠিন। তিনি ব্যক্তিগতভাবে মনে করেন, অতিরিক্ত মুনাফার লোভে কিছু ব্যবসায়ী দাম কমাতে আগ্রহী নন। সব ব্যবসায়ীর এই পণ্য আমদানির সক্ষমতাও নেই। অনেক সময় উন্মুক্ত দরপত্রেও কাঙ্ক্ষিত আমদানিকারক পাওয়া যায় না। ফলে বাজারের নিয়ন্ত্রণ গুটিকয়েক ব্যবসায়ীর হাতে চলে যায়। দেশের প্রকৃত চাহিদা কত, তা স্পষ্ট নয়। জনসংখ্যার ওপর ভিত্তি করে হিসাব করা হয়। কিন্তু অনেকের মতে, জনসংখ্যার তথ্য সঠিক নয়। এছাড়া পোল্ট্রি, গবাদিপশু ও মৎস্য খাতের প্রকৃত চাহিদা সম্পর্কেও সঠিক তথ্য নেই। এতে সরবরাহ ও চাহিদার ভারসাম্য এবং মূল্য নির্ধারণে প্রভাব পড়ে।
চালের বাজার:
গত ৯ নভেম্বর খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ কমিটির সভায় উপস্থাপিত প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০২৪ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৫ সালের অক্টোবরের মধ্যে মোটা, মাঝারি ও সরু সব ধরনের চালের পাইকারি ও খুচরা দাম বেড়েছে। খুচরা পর্যায়ে চালের দাম কেজিতে ন্যূনতম ৮৫ পয়সা থেকে সর্বোচ্চ ৪.৪৩ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে সরু চালের দাম।
২০২৪ সালের অক্টোবরে দেশে প্রতি কেজি মোটা চাল বিক্রি হয়েছিল ৫১.৪৩ টাকায়, মাঝারি মানের চাল ৬১.২৫ টাকায় এবং সরু জাতের চাল ৭২.৬৭ টাকায়। ২০২৫ সালের অক্টোবর মাসে দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ৫২.২৮, ৬২.৪৩ ও ৭৭.১০ টাকায়। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)-এর ২০ নভেম্বরের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার বাজারে দাম আরও বেশি।
অন্যদিকে, একই সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে চালের দাম অনেকটা কমেছে। ২০২৪ সালের অক্টোবরে থাইল্যান্ডে প্রতি টন চালের দাম ছিল ৫৩৫ ডলার, ভারতে ৪৯৫ ডলার এবং ভিয়েতনামে ৫৪৭ ডলার। ২০২৫ সালের অক্টোবরের মধ্যে দাম কমে যথাক্রমে ৩৭৪, ৩৫৪ ও ৩৫৬ ডলারে নেমেছে। বাংলাদেশ এই তিনটি দেশ থেকে চাল আমদানি করে। তবুও বিশ্ববাজারে দাম কমার সুবিধা দেশের বাজারে পৌঁছায়নি।
গম-আটার দাম বাড়ছে:
২০২৪ সালের অক্টোবর মাসে দেশে প্রতি কেজি গম ও আটার দাম ছিল ৪১.৩৬ টাকা। এক বছর পর, ২০২৫ সালের অক্টোবরের মধ্যে গমের দাম বেড়ে ৪৪.০৬ টাকা এবং আটা ৪৪.৯২ টাকায় পৌঁছেছে। খুচরা বাজারে গমের দাম ২.৭০ টাকা এবং আটার দাম ৩.৫৬ টাকা বেড়েছে।
অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক বাজারে গমের দাম উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। ২০২৪ সালের অক্টোবরে যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি টন ‘রেড সফট’ গমের দাম ছিল ২৩৩ ডলার এবং ‘রেড হার্ড’ গমের দাম ২৭২ ডলার। ইউক্রেনে দাম ছিল ২৩৯ ডলার, রাশিয়ায় ২৩৫ ডলার এবং আর্জেন্টিনায় ২৪২ ডলার। ২০২৫ সালের অক্টোবরে এসব দাম কমে যথাক্রমে ২০৯, ২৩০, ২৩৫, ২৩0 ও ২১৮ ডলারে নেমে এসেছে।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি এএইচএম শফিকুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশের চালের বাজার আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক খুব কম। তিনি বলেন, ‘যদিও সাম্প্রতিক সময়ে সরকারি ও বেসরকারি খাতে চাল আমদানি হচ্ছে, বাজার মূলত বড় মিলার ও কর্পোরেট গ্রুপের ওপর নির্ভরশীল। এখন বাজারদর কেজিতে ১০ থেকে ১৫ টাকা পর্যন্ত বেশি।’
শফিকুজ্জামান আরও বলেন, ‘চালের পর্যাপ্ত সরবরাহ আছে। সরকারি নিয়মে মজুত হচ্ছে কি না, তা দেখা দরকার। নওগাঁ, দিনাজপুর, কুষ্টিয়াসহ প্রধান ধান উৎপাদনকারী এলাকা মনিটরিং করা উচিত।’ তিনি জানান, গম ও আটার দাম চালের তুলনায় বিশ্ববাজারের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। ব্যবসায়ীরা গম কেনার পর দেশে আনার জন্য এলসি খোলার পর দুই মাস সময় লাগে। ‘সরকার ভোগ্যপণ্য আমদানি, এলসি খোলা ও পণ্য খালাসে সুবিধা দিচ্ছে। তবুও ভোক্তারা সেই সুবিধা পাচ্ছেন না।’
মেঘনা গ্রুপের উপ-মহাব্যবস্থাপক তাসলিম শাহরিয়ার বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে গমের দাম কমেছে—এই দাবি পুরোপুরি সঠিক নয়। বিশ্বজুড়ে উৎপাদন বেড়েছে, কিন্তু লজিস্টিক খরচও বেড়েছে। তবে ভবিষ্যতে দেশে দাম কমতে পারে।’
খাতুনগঞ্জের অ্যারোফা ট্রেডিংয়ের স্বত্বাধিকারী জহিরুল হক বলেন, ‘গমের কোনো ঘাটতি নেই। যথেষ্ট সরবরাহ আছে। দামও সহনশীল পর্যায়ে আছে। সম্ভবত সামান্য কমতে পারে।’
প্রাণ গ্রুপের পরিচালক কামরুজ্জামান কামাল বলেন, ‘গমের দাম কমলেও গমজাত পণ্যের অন্যান্য উপকরণ—ভোজ্যতেল, চিনি, বাটার অয়েল—এবং শ্রমিক ও পরিবহন খরচ কমেনি। তাই সাথে সাথে পণ্যের দাম কমানো সম্ভব হয়নি। তবে ভবিষ্যতে দাম কমার সম্ভাবনা আছে।’

