বাংলাদেশ বহু বছর ধরেই ভূমিকম্পপ্রবণ দেশের তালিকায় রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বারবার সতর্ক করলেও প্রস্তুতির ঘাটতি রয়ে গেছে স্পষ্টভাবেই। শুক্রবার সকালে যে ভূমিকম্পে পুরো দেশ কেঁপে উঠেছিল, সেটি সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী। ৫.৭ মাত্রার সেই ঝাঁকুনি বিশেষজ্ঞদের চোখে বড় বিপদের আগাম বার্তা। এরপরের তিন দফা কম্পনও এই আতঙ্ক আরও ঘনীভূত করেছে।
ঠিক এমন সময় প্রকাশিত গ্লোবাল আর্থকোয়াক মডেলিং (জেম) ফাউন্ডেশনের নতুন গবেষণা জানাচ্ছে, বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে বাংলাদেশে ৩৪৪ বিলিয়ন ডলার সমমূল্যের সম্পদ মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়তে পারে। দেশের মোট জিডিপির প্রায় তিন-চতুর্থাংশের সমান এই অর্থনৈতিক ঝুঁকি যে ভয়াবহ, তা স্পষ্টই বোঝা যায়।
২০২৩ সালে জাতিসংঘের সহায়তায় করা এই বিস্তৃত গবেষণায় দেখা যায়, দেশের অধিকাংশ ভবনই ভূমিকম্প প্রতিরোধী নকশায় নির্মিত নয়। ভবন নির্মাণে বিল্ডিং কোড না মানা, অপ্রকৌশলগত কাঠামোর আধিক্য এবং নদীভিত্তিক নরম মাটির কারণে বহু স্থানে তরলীকরণ ঝুঁকি অত্যন্ত বেশি—সব মিলিয়ে বড় ধরনের কম্পনে ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কাই বেশি।
গবেষণায় ৭টি অঞ্চলের মোট ২ কোটি ৯০ লাখ ভবন বিশ্লেষণ করা হয়েছে। সেগুলোর বর্তমান সম্পদমূল্য ধরা হয়েছে ৩৪৪ বিলিয়ন ডলার, আর পুরোপুরি প্রতিস্থাপন করতে লাগবে আরও বেশি—৩৫৬ বিলিয়ন ডলার।
কোন অঞ্চলে ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি?
সবচেয়ে বড় ঝুঁকিতে ঢাকা ও চট্টগ্রাম অঞ্চল।
-
ঢাকা: ৯০ লাখ ভবনের জন্য প্রতিস্থাপন ব্যয় ১৪৯ বিলিয়ন ডলার
-
চট্টগ্রাম: ৫০ লাখ ভবন প্রতিস্থাপনে দরকার ৬২ বিলিয়ন ডলার
-
রাজশাহী: ৪২ বিলিয়ন ডলার
-
খুলনা: ৩৪ বিলিয়ন ডলার
-
রংপুর: ৩৪ বিলিয়ন ডলার
-
সিলেট ও বরিশাল: প্রতিটি অঞ্চলে অন্তত ১৭ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন হবে
এছাড়া দেশের উত্তর ও পূর্বাঞ্চলে সিসমিক বিপদ সবচেয়ে বেশি, কারণ সক্রিয় ফল্ট জোনগুলো সেই এলাকায় কেন্দ্রীভূত।
বুয়েটের অধ্যাপক ড. মেহেদী আহমেদ আনসারীর মতে, প্রতিটি ভবনের কাঠামোগত অবস্থার ল্যাবরেটরি পরীক্ষা জরুরি, বিশেষ করে ঢাকায়। তার মতে:
“রাজউক ঘোষণা দিলেই হয়—ত্রুটিপূর্ণ ভবনগুলোকে রেট্রোফিটিং করে সনদ জমা দিতে হবে, নইলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এতে সরকারকে অতিরিক্ত অর্থ দিতে হবে না, বরং সবাই বাধ্য হবে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে।”
রানা প্লাজা ধসের অভিজ্ঞতা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ছোট ভুলের বড় মূল্য দিতে হয়। শুক্রবারের ভূমিকম্পে যেসব ভবনে ফাটল দেখা গেছে, ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলে সেই ক্ষয়ক্ষতি বহু গুণ বাড়বে। অনুমান করা হচ্ছে—
-
ঢাকার ৩৫% ভবন ধসে পড়তে পারে
-
২‑৩ লাখ মানুষ হতাহত হওয়ার আশঙ্কা আছে
এটি কেবল সংখ্যা নয়, সম্ভাব্য ভয়াবহ মানবিক ট্র্যাজেডির ইঙ্গিত।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সব ভবন ভেঙে নতুন করে নির্মাণ করা বাস্তবে সম্ভব নয়। এতে সময়, অর্থ, পরিকাঠামো—সব ক্ষেত্রেই অচলাবস্থা তৈরি হবে। তুলনায় রেট্রোফিটিং অনেক বেশি যৌক্তিক ও বাস্তবসম্মত সমাধান। সঠিকভাবে রেট্রোফিটিং করা হলে একটি পুরনো ভবনের স্থায়িত্বও ৫০ বছর বা তার বেশি বাড়ানো যায়।
তবে এটি ব্যয়সাপেক্ষ হওয়ায় ব্যক্তিমালিকানাধীন ভবনগুলোর ক্ষেত্রে অনেকেই এগোতে চান না। বড় শিল্প স্থাপনাগুলোতে এটি তুলনামূলকভাবে সহজে করা সম্ভব।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. সৈয়দ হুমায়ূন আখতারের মতে, ভবন ভাঙা বা নতুন করে নির্মাণের পরামর্শ বাস্তবে সব মানুষের সামর্থ্যের মধ্যে পড়ে না। তিনি বলেন:
“সচেতনতা বাড়ানোই সবচেয়ে জরুরি। আজ সবাই স্মার্টফোন ব্যবহার করে—একটি আকর্ষণীয় অ্যাপ বা গেমের মাধ্যমেও ভূমিকম্পের সময় করণীয় শেখানো যেতে পারে।”
বিশেষজ্ঞরা আরও মনে করিয়ে দিয়েছেন, রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পর ঢাকার ভবনগুলোকে ঝুঁকির ভিত্তিতে লাল, হলুদ ও সবুজ—এভাবে কালার কোড করার যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, সেই তালিকা কখনো প্রকাশিত হয়নি।
এই তালিকা প্রকাশ করলে মানুষ নিজের ভবন সম্পর্কে সচেতন হবে এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে উৎসাহিত হবে।
বাংলাদেশে ভূমিকম্প আর সম্ভাবনার বিষয় নয়—এটি সময়ের প্রশ্ন। প্রস্তুতি ছাড়া বড় মাত্রার কম্পন যদি আসে, তবে অর্থনৈতিক ক্ষতি ছাড়াও ব্যাপক মানবিক বিপর্যয় অনিবার্য।
তাই এখনই প্রয়োজন—
-
শক্তিশালী ভবন নির্মাণ নীতি
-
রেট্রোফিটিংকে বাধ্যতামূলক করা
-
ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা প্রকাশ
-
এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ—মানুষকে সচেতন করা
এটি শুধু স্থাপনার নিরাপত্তার প্রশ্ন নয়, কোটি মানুষের জীবন বাঁচানোর লড়াই।

