রাজস্ব আয় বাড়াতে এনবিআরে ব্যাপক সংস্কার চলছে। আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী পদক্ষেপগুলোও নেওয়া হচ্ছে। নতুন নীতি, প্রকল্প ও কাঠামো তৈরি হয়েছে। নথি-প্রকল্পে অগ্রগতি আছে। কিন্তু এসব উদ্যোগের রাজস্ব আহারে কোনো স্পষ্ট ছাপ দেখা যায়নি। ঘাটতি আগের মতোই স্থির। মাসওয়ারি ও বছরওয়ারি লক্ষ্য অনুযায়ী অর্জন এখনও পুরোনো ধাঁচেই।
সংস্কারের ধারাবাহিকতায় ই-রিটার্ন, ই-টিআইএন, ই-অডিট, আইভিএএস ও ই-ইনভয়েসের মতো প্রযুক্তিনির্ভর পদক্ষেপগুলো ভবিষ্যতের রাজস্ব প্রশাসনের ভিত্তি হিসেবে কাজ করছে। করদাতাদের সুবিধার জন্য কলসেন্টার ও অনলাইন ট্রেনিংও চালু হয়েছে। তবে বাস্তবায়নের বেশির ভাগই এখনও মধ্যপথে। মাঠপর্যায়ে প্রভাব সীমিত। প্রযুক্তি বাড়ছে, প্রক্রিয়া বদলাচ্ছে, তবু রাজস্ব আহারে তার ধাক্কা এখনো পৌঁছায়নি। রাজস্বপ্রবাহ আগের ধীর গতিতেই আটকে আছে।
চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে এনবিআরের আদায় হয়েছে ১ লাখ ১৯ হাজার ৪৭৮ কোটি টাকা। লক্ষ্য ছিল ১ লাখ ৩৬ হাজার ৬৯৭ কোটি। ঘাটতি ১৭ হাজার ২১৯ কোটি বা ১২ দশমিক ৬০ শতাংশ। যদিও আগের বছরের একই সময়ে প্রবৃদ্ধি ছিল ১৫ দশমিক ৫৪ শতাংশ। অর্থাৎ এ বছর প্রবৃদ্ধি ইতিবাচক, তবু লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে ব্যবধান বাড়তি চাপ সৃষ্টি করছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ব্যবসার গতি না বাড়লে রাজস্ব আদায়ও বাড়বে না। চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের গবেষণা ফেলো ও অর্থনীতিবিদ এম হেলাল আহমেদ জনি বলেন, অর্থনীতি অস্থিতিশীল, ব্যবসার গতি মন্থর। আমদানি-রপ্তানি প্রত্যাশামতো বাড়ছে না। কাস্টমসে শুল্ক আদায় কমছে, ভ্যাটে লিকেজ বাড়ছে, বিক্রি গোপনের প্রবণতা থামছে না। কাঠামোগত দুর্বলতা, সংকীর্ণ করজাল, অনানুষ্ঠানিক খাতে কর পৌঁছানো ব্যাহত হওয়া—সব মিলিয়ে রাজস্ব বৃদ্ধির সম্ভাবনা আটকে যাচ্ছে। সাবেক আমলা ও জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ফিরোজ মিয়া মনে করেন, এনবিআরের সাম্প্রতিক অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা, বদলি ও সাজামূলক ব্যবস্থার কারণে কর্মকর্তাদের মনোযোগ প্রভাবিত হয়েছে। মাঠে রাজস্ব সংগ্রহে তার প্রভাব পড়েছে।
হালনাগাদ রাজস্ব তথ্যও এই ছবি ফুটিয়ে তোলে। আয়কর, কাস্টমস ও ভ্যাট—সব খাতেই ঘাটতি। ভ্যাট থেকে ৪৬ হাজার ৮৭৮ কোটি টাকা আদায় হয়েছে, লক্ষ্য ছিল ৪৮ হাজার ১৪৬ কোটি। ঘাটতি ১ হাজার ২৬৮ কোটি বা ২ দশমিক ৬৩ শতাংশ। গত বছরের একই সময়ে ভ্যাট আদায় ছিল ৩৭ হাজার ৫৬৭ কোটি। ফলে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৪ দশমিক ৭৮ শতাংশ।
আয়কর খাতে রাজস্ব এসেছে ৩৭ হাজার ৮৪৯ কোটি, লক্ষ্য ছিল ৪৭ হাজার ৪৩ কোটি। ঘাটতি ৯ হাজার ১৯৪ কোটি বা ১৯ দশমিক ৫৪ শতাংশ। আগের বছরের একই সময়ে আদায় ছিল ৩২ হাজার ৫৯৭ কোটি। প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৬ দশমিক ১১ শতাংশ। কাস্টমস বা শুল্কে আদায় হয়েছে ৩৪ হাজার ৭৫১ কোটি, লক্ষ্য ছিল ৪১ হাজার ৫০৭ কোটি। ঘাটতি ৬ হাজার ৭৫৬ কোটি বা ১৬ দশমিক ২৭ শতাংশ। আগের বছরের একই সময়ে আদায় ছিল ৩৩ হাজার ২৪৩ কোটি। প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪ দশমিক ৫৩ শতাংশ।
এনবিআরের শীর্ষ কর্মকর্তারা আশা করছেন, বছরের শেষ দিকে রাজস্ব সংগ্রহ বাড়বে। করজাল বৃদ্ধি, কর ফাঁকি রোধ ও বকেয়া রাজস্ব পুনরুদ্ধারে জোর দেওয়া হচ্ছে। চলতি অর্থবছরে এনবিআরের মূল লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা। পরে তা ৫ লাখ ৩ হাজার কোটি টাকা করা হয়েছে। বাকি আট মাসে আদায় করতে হবে ৩ লাখ ৮৩ হাজার ৫২২ কোটি, যা বাস্তবতার সঙ্গে তুললে কঠিন লক্ষ্য।
সাবেক চেয়ারম্যান ড. আব্দুল মজিদ মনে করেন, রাজস্ব ঘাটতির মূল কারণ লক্ষ্য নির্ধারণে ভুল। তাঁর ভাষায়, “এনবিআরের সক্ষমতার বাইরে লক্ষ্য দেওয়া হয়। এখানেই সমস্যার শুরু।” অর্থাৎ সংস্কার, কাঠামো ও নীতির পরিবর্তন প্রয়োজন, কিন্তু লক্ষ্য ও বাস্তবতার ব্যবধান না কমালে রাজস্ব প্রবাহের গতি বাড়ানো কঠিন।

