সিঙ্গাপুরের র্যাফলস প্লেস ফাইন্যান্সিয়াল হাব হিসেবে পরিচিত এবং নগররাষ্ট্রটির সবচেয়ে ব্যস্ত করপোরেট এলাকা। এখানে রয়েছে প্রধান ব্যাংক, আন্তর্জাতিক ব্যাংকের আঞ্চলিক কার্যালয়, বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান, বীমা কোম্পানি ও বিভিন্ন আর্থিক সেবা সংস্থা।
একাধিক সূত্র জানিয়েছে, র্যাফলস প্লেস এলাকায় প্রায়ই দেখা যায় বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের একজন বিশেষ দূতকে। জানা গেছে, তিনি কর্মসময়ের একটি বড় অংশ সিঙ্গাপুরে কাটান। সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপ থেকে জানা গেছে, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর বড় সরকারি ক্রয় সিদ্ধান্তগুলোর পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন এই উপদেষ্টা পদমর্যাদার বিশেষ দূত। শুধু সরকারি ক্রয় নয়, বন্দর সংক্রান্ত বিদেশী চুক্তির পেছনেও তার সক্রিয় অবদান আছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ওই বিশেষ দূত তার পেশাগত জীবনের বড় সময় সিঙ্গাপুরে কাটিয়েছেন। তিনি সেখানে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াতেন এবং এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্যের গতিপ্রকৃতি পর্যালোচনার দায়িত্বে ছিলেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তিনি নিজেও জানিয়েছেন, কখনো দর্শক হিসেবে কখনো সরাসরি কাজে নিযুক্ত থেকে সিঙ্গাপুরের বিকাশ দেখেছেন। এছাড়া তার স্ত্রী সিঙ্গাপুরিয়ান হওয়ায় দেশটি তার স্থায়ী আবাসস্থলের মতো।
বর্তমান সরকারের বড় ক্রয় কার্যক্রমের অনেকটাই কেন্দ্রভিত্তিক সিঙ্গাপুরে। জ্বালানি ছাড়াও এসব ক্রয়ের মধ্যে রয়েছে গম ও চাল। বিশেষ দূত এসব কার্যক্রম কখনো সরাসরি সিঙ্গাপুরে গিয়ে, কখনো দূর থেকে পরিচালনা করেন। জানা গেছে, প্রতিটি ক্রয় সিদ্ধান্তের আগে বা পরে তিনি সিঙ্গাপুর সফর করেন। অনেকে এটিকে ‘সিঙ্গাপুরফিলিয়া’ হিসেবে দেখছেন। অর্থাৎ দেশের পণ্যের প্রতি আকর্ষণ বা পছন্দকে ইংরেজি ভাষায় ‘ফিলিয়া’ বলা হয়, আর সিঙ্গাপুর থেকে পণ্য কেনার আগ্রহকে বলা হচ্ছে সিঙ্গাপুরফিলিয়া।
গত ৯ সেপ্টেম্বর সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সম্মেলন কক্ষে সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠক সভাপতিত্ব করেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। সভায় তিনটি প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়। এর মধ্যে ছিল দেশে জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে সিঙ্গাপুর থেকে দুই কার্গো এলএনজি আমদানির সিদ্ধান্ত। এর ব্যয় ধরা হয়েছে ১,০৮৫ কোটি ৬১ লাখ টাকা।
সম্প্রতি বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে গম আমদানি করেছে। তবে ঋণপত্র অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা ওই গমের অর্থ পরিশোধ হবে সিঙ্গাপুরের সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের মাধ্যমে। সর্বশেষ, সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটি বাজার স্থিতিশীল রাখতে সিঙ্গাপুরের সরবরাহকারীর মাধ্যমে ভারত থেকে চাল কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এসব ক্রয় কার্যক্রমের নেপথ্যে রয়েছেন বাংলাদেশের বিশেষ দূত।
গতকাল সিঙ্গাপুর থেকে ৫০ হাজার টন নন-বাসমতি সেদ্ধ চাল কেনার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এ চাল কেনার জন্য ব্যয় হবে ২১৭ কোটি ৮ লাখ ৭৬ হাজার ৯৫০ টাকা। প্রতি কেজি চালের দাম ধরা হয়েছে ৪৩ টাকা ৪১ পয়সা। এ বিষয়ে ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, “চালের দাম কিছুটা স্থিতিশীল হয়েছে, আবার কিছুটা বাড়ছে। অতএব চালের দাম যেন কোনোক্রমে না বাড়ে সেজন্য আমরা নন-বাসমতি চাল আবার আনব।” চাল আসবে কোন দেশ থেকে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “নন-বাসমতি চাল ভারত থেকে আসবে। দাম প্রতিযোগিতামূলক। সরবরাহকারী সিঙ্গাপুরের। আমরা মান, সময়মতো সরবরাহ ও দাম বিবেচনা করেছি।”
এর আগে, ৭ অক্টোবর সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির সভায় যুক্তরাষ্ট্র থেকে সরকার টু সরকার পদ্ধতিতে ২ লাখ ২০ হাজার টন গম আমদানি করার প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়। খাদ্য মন্ত্রণালয় এ গম কেনার প্রস্তাব উত্থাপন করেছিল। ইউএস হুইট অ্যাসোসিয়েটস কর্তৃক অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান এগ্রোকর্প ইন্টারন্যাশনাল পিটিই লিমিটেড থেকে এ গম কেনার ব্যয় ধরা হয়েছে ৮২৫ কোটি ৩১ লাখ ৬৮ হাজার টাকা। প্রতি টন গমের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৩০৮ ডলার।
ব্যবসায়ীদের দাবি, যুক্তরাষ্ট্র থেকে যে গম কেনা হচ্ছে তার দাম তুলনামূলকভাবে বেশি পড়ছে। গত ২৫ জুন সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির সভায় সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রতিষ্ঠান মেসার্স সেরেল কর্পস ট্রেডিং এলএলসির কাছ থেকে ৫০ হাজার টন গম আমদানি করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। এ সময় প্রতি টনের দাম ধরা হয়েছিল ২৭৫ ডলার। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্র থেকে গম আনতে প্রতি টনে প্রায় ৩৩ ডলার বাড়তি ব্যয় হচ্ছে।
গম ক্রয়সংক্রান্ত চুক্তি অনুযায়ী, রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক সিঙ্গাপুরে এগ্রোকর্প ইন্টারন্যাশনালের পক্ষে ঋণপত্র বা এলসি ইস্যু করে। সাইট পেমেন্টভিত্তিক ঋণপত্র বাণিজ্য দলিল যাচাই হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অর্থ প্রদানযোগ্য হয়। পণ্য সরবরাহের পর রফতানিকারক এগ্রোকর্প তার দলিল সিঙ্গাপুর স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকে জমা দেবে। বাংলাদেশের অর্থ সেই ব্যাংকে জমা হয়।
সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ২০২৪ সালে বাংলাদেশ ও সিঙ্গাপুরের মোট বাণিজ্য ৩২৩ কোটি ডলারের কিছু বেশি। এর মধ্যে ৩০৫ কোটি ডলার পণ্য আমদানি বাবদ সিঙ্গাপুরে পরিশোধ করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) গত বছরের একই সময়ের তুলনায় সিঙ্গাপুর থেকে আমদানি প্রায় ৩ শতাংশ বেড়েছে। ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে সিঙ্গাপুর থেকে আমদানি বাবদ পরিশোধমূল্য কমেছিল, তবে এখন তা আবার ঊর্ধ্বমুখী। সরকারি-বেসরকারি ব্যবসায়ীরা মনে করেন, এতে বিশেষ দূতের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।
শুধু সিঙ্গাপুরকেন্দ্রিক ক্রয় কার্যক্রম নয়। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর প্রশাসনের কিছু কর্মকর্তা ও উপদেষ্টা নীতিনির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন। এর মধ্যে অন্যতম ওই বিশেষ দূত। আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সঙ্গে সমন্বয়ের দায়িত্ব পেলেও পরবর্তী সময়ে তিনি সরকারের নীতি বাস্তবায়ন, বিশেষ করে ক্রয় কার্যক্রমে অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য ও কার্যকর ব্যক্তিত্ব হিসেবে বিবেচিত হয়েছেন।
সূত্রের দাবি, সরকারি ক্রয় ব্যবস্থাকে স্বচ্ছ ও প্রতিযোগিতামূলক করার অজুহাতে তিনি নেপথ্যে থেকে গুরুত্বপূর্ণ সমন্বয়মূলক দায়িত্ব পালন করেছেন। বিশেষ করে ক্রয়সংক্রান্ত টেকনিক্যাল রিপোর্ট, প্রাইস বেঞ্চমার্কিং, আন্তর্জাতিক চর্চা ও ঝুঁকি পর্যবেক্ষণ বিষয়গুলো ঘনিষ্ঠভাবে তদারকি করেছেন।
প্রশাসনের ভেতরে তার অবস্থানকে অনেকেই কৌশলগত বলে চিহ্নিত করেন। প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশিত নীতিগত দিকনির্দেশনা বাস্তবায়নে তিনি দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণে ভূমিকা রাখেন এবং প্রক্রিয়াসংক্রান্ত জটিলতা কমিয়ে আনেন। শুধু সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত নয়, আন্তর্জাতিক মহলের সঙ্গে সমন্বয়ের ক্ষেত্রেও উপদেষ্টা পদমর্যাদার ওই বিশেষ দূতের কার্যক্রম নিয়ে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের একটি অংশ উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তাদের দাবি, আন্তর্জাতিক মহলের বিভিন্ন এজেন্ডা থাকে, যা রাজনৈতিক সরকারের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জাতীয় স্বার্থ সুরক্ষা করে দরকষাকষির মাধ্যমে মোকাবেলা করা হয়।
তবে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর ওই বিশেষ দূতের ভূমিকায় আন্তর্জাতিক মহলের অনেক অন্যায্য দাবি সরকার মেনে নিয়েছে। ব্যবসায়ীরা মনে করেন, যদিও তাৎক্ষণিকভাবে প্রশংসা কুড়ালেও ভবিষ্যতে বাংলাদেশের শিল্প খাতে দীর্ঘমেয়াদি সংকট তৈরি হতে পারে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে দেশের শীর্ষস্থানীয় এক ব্যবসায়ী বলেন, “সরকারি ক্রয়ে ওই বিশেষ দূতের ভূমিকা সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কিছু বলা কঠিন। তবে শুনেছি, ক্রয় কার্যক্রমের নেপথ্যে তার সক্রিয় ভূমিকা রয়েছে। আন্তর্জাতিক মহলের অন্যায্য দাবিদাওয়া মেনে নেয়ার ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থ যথাযথভাবে বিবেচনা করা হয়নি। এতে ভবিষ্যতে সংকট দেখা দিতে পারে।”
বাংলাদেশ থেকে বিগত আওয়ামী আমলে আমদানির আড়ালে অর্থ পাচারের একটি আলোচিত গন্তব্য ছিল সিঙ্গাপুর। বিভিন্ন সরকারি অনুসন্ধানেও বিষয়টি উঠে এসেছে। বেসরকারি গবেষণায় দেখা গেছে, বিগত সরকারের সময় বাংলাদেশী অলিগার্কদের অনেকের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, প্রাইভেট ফান্ড এবং সেকেন্ড-হোম সিঙ্গাপুরে রয়েছে। অনেক অলিগার্ক সিঙ্গাপুরে নিবন্ধিত অফশোর কোম্পানির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক লেনদেন পরিচালনা করেন। রিয়েল এস্টেট ও ব্যবসায়িক বিনিয়োগের সহজ প্রক্রিয়ার কারণে এই পথ বেশি ব্যবহৃত হয়। দায়িত্ব গ্রহণের পরই অন্তর্বর্তী সরকার আওয়ামী আমলে বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার উদ্যোগ নেয়। এর ধারাবাহিকতায় সিঙ্গাপুরে থাকা পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, সিঙ্গাপুরের আইনি কাঠামোয় অবৈধ অর্থ উদ্ধার এবং উৎস দেশে ফেরত দেয়ার বিধি রয়েছে। বাংলাদেশ যদি সিঙ্গাপুর থেকে অর্থ ফেরত চায়, তাহলে মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স (এমএলএ) অনুরোধ জানাতে হবে। এতে আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে সিঙ্গাপুর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সমন্বয় নিশ্চিত করতে হয়।

