রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন কোম্পানি লিমিটেড গত বছর আগস্টে গ্রিডে ১২১ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করেছিল। তবে গতকাল তা ৮১ মিলিয়ন ঘনফুটে নেমে এসেছে। হিসাব অনুযায়ী, ১৬ মাসের মধ্যে সংস্থাটির গ্যাস সরবরাহ ৩৩ শতাংশের বেশি কমেছে।
অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর স্থানীয় গ্যাস সরবরাহ বৃদ্ধি ও বাপেক্সের কার্যক্ষমতা বাড়ানোর জন্য সংস্থাকে অর্থায়ন, কূপ খননে যন্ত্রাংশ ক্রয়সহ বিভিন্ন সুবিধা দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে গ্রিডে বাপেক্সের গ্যাস সরবরাহ ক্রমবর্ধমান হারে কমতে থাকে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগের আওয়ামী সরকারের আমলে বাপেক্সকে কার্যত স্থবির করে রাখা হয়েছিল। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর সংস্থাকে আধুনিকায়ন, উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধি, আধুনিক প্রযুক্তি ও বিনিয়োগসহ উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। তবে বাস্তবে তা কূপ খনন, সীমিত বিনিয়োগ এবং রিগ আধুনিকায়ন ও ক্রয়ের মধ্যেই সীমিত থেকেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সংস্থার কারিগরি দক্ষতা ও বড় বিনিয়োগের মাধ্যমে গ্যাস সরবরাহ আরও বাড়ানো যেত। পেট্রোবাংলা ও বাপেক্সের কর্মকর্তারা দাবি করেছেন, গ্যাস উৎপাদন কমেনি। বরং সরবরাহের আরও সক্ষমতা থাকলেও অবকাঠামোগত জটিলতার কারণে তা করা যাচ্ছে না।
দেশে তেল ও গ্যাস উত্তোলন এবং জরিপকাজে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা হিসেবে কাজ করছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন কোম্পানি লিমিটেড (বাপেক্স)। বিগত আওয়ামী সরকারের আমলে সংস্থাটিতে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ না দেওয়ার অভিযোগ ছিল। তবে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পরও বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাপেক্সের আর্থিক অবস্থা তেমন বড় পরিবর্তন পায়নি।
চলতি অর্থবছরে গ্যাস কূপ খনন ও উন্নয়ন কার্যক্রমের জন্য তিনটি প্রকল্পের আওতায় এডিপিতে মোট বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৩৪১ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। অথচ এই তিন প্রকল্পের মোট ব্যয়ের প্রাক্কলন ১ হাজার ৯৬৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এর মধ্যেও বাপেক্সসহ দেশে কার্যক্রম চালানো সব কোম্পানির গ্যাস সরবরাহ কমছে। মজুদ গ্যাস আবিষ্কার না হওয়ায় অন্তর্বর্তী সরকার এলএনজি আমদানি বাড়িয়েছে। চলতি অর্থবছরে পেট্রোবাংলার লক্ষ্য প্রায় ৫৮ হাজার কোটি টাকার এলএনজি ক্রয়।
বাপেক্সের নিজস্ব গ্যাস উৎপাদন বৃদ্ধি না হওয়ার পেছনে কিছু কারণ রয়েছে। সংস্থাটিকে অন্য কোম্পানির কূপ খননকাজেও যুক্ত রাখা হয়েছে। এছাড়া জরিপ ও সরবরাহ কার্যক্রমের আওতা বেশি থাকায় নিজস্ব উৎপাদনে পূর্ণ মনোযোগ দিতে পারছে না সংস্থা। বিগত সরকারের ১০০ কূপ খনন পরিকল্পনায় বাপেক্সকে বড় পরিসরে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তবে উচ্চাভিলাষী এই পরিকল্পনার যৌক্তিকতা নিয়েও জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা প্রশ্ন তুলেছেন।
পেট্রোবাংলার তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ১ আগস্ট গ্রিডে গ্যাস সরবরাহ ছিল ২ হাজার ৬৩৪ মিলিয়ন ঘনফুট। এর মধ্যে বাপেক্সের সরবরাহ ছিল ১২১ মিলিয়ন ঘনফুট। চলতি মাসের হিসাব অনুযায়ী তা নেমে এসেছে ৮১ মিলিয়ন ঘনফুটে। অর্থাৎ এক বছরেরও বেশি সময়ে বাপেক্সের গ্যাস সরবরাহ কমেছে ৩৩ শতাংশের বেশি। তবে এর মধ্যে মাসভিত্তিক সরবরাহে উৎপাদনে তারতম্য দেখা গেছে। জ্বালানি বিভাগের পক্ষ থেকে ক্রমহ্রাসের বিষয়টি পুরোপুরি অস্বীকার করা হয়নি। মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সংস্থার সক্ষমতা বৃদ্ধি ও আধুনিকায়নের জন্য সব ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, “বাপেক্সের গ্যাস উৎপাদন কমে যাচ্ছে এমন নয়, বরং গ্যাসের রিজার্ভ কমে যাচ্ছে। গত এক বছরে দৈনিক ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের সরবরাহ কমেছে, বিপরীতে পাওয়া গেছে ৬০ মিলিয়ন ঘনফুট। গ্যাস উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য কূপ খননের যে লক্ষ্যমাত্রা নেয়া হয়েছে, সেই অনুযায়ী কাজ করছে বাপেক্স। তাদের সব ধরনের সাপোর্ট দেয়া হচ্ছে। আর বলার সুযোগ নেই যে কোনো ধরনের সাহায্য দেওয়া হচ্ছে না।”
তবে সংস্থার নিজস্ব কূপের সংস্কার ও উৎপাদন বৃদ্ধিতে বিশেষ কোনো অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। ভোলার শাহবাজপুর ফিল্ডের সরবরাহ দৈনিক ৫০ মিলিয়ন ঘনফুটের কিছু বেশি হলেও বাকি সাতটি ফিল্ডের উৎপাদন মাত্র ৩০ মিলিয়ন ঘনফুট। বিস্তারিত ফিল্ড ভিত্তিক উৎপাদন হলো:
- সালদানদী: ২.৪ মিলিয়ন ঘনফুট
- ফেঞ্চুগঞ্জ: ৩.৮ মিলিয়ন ঘনফুট
- সেমুতাং: ১ মিলিয়ন ঘনফুটের নিচে
- সুন্দলপুর ও শ্রীকাইল: মোট ১১ মিলিয়ন ঘনফুট
- বেগমগঞ্জ: ১০ মিলিয়ন ঘনফুট
- রূপগঞ্জ: সরবরাহ বন্ধ
ভোলা নর্থ গ্যাস ফিল্ডে ৪৫০ বিসিএফ গ্যাস পাওয়া গেলেও দীর্ঘ সময়েও উত্তোলন করা সম্ভব হয়নি। সিলেটের জকিগঞ্জে ৪৮ বিসিএফ গ্যাস মজুদ থাকলেও গ্রিডে কোনো সরবরাহ যুক্ত হয়নি। নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে বাপেক্সের শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, “গ্যাস উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য পাঁচটি রিগ দিয়ে বাপেক্সসহ বিভিন্ন কোম্পানির কূপ খনন কার্যক্রম চলছে। এগুলো শেষ হলে উৎপাদন কিছুটা বাড়বে। তবে ভোলার গ্যাস যদি গ্রিডে যুক্ত হতো, উৎপাদন আরও বেশি হতো। এছাড়া স্থলভাগের শ্রীকাইল ও কৈলাসটিলা খননের কাজ শেষ হলে গ্রিডে আরও গ্যাস যুক্ত হবে।”
বর্তমানে গ্রিডে দৈনিক গ্যাস সরবরাহে বাপেক্সের অবদান ৩.১০ শতাংশ। তিন বছর আগে সংস্থার অবদান ছিল ৭ শতাংশের বেশি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ক্রমান্বয়ে উৎপাদন হ্রাস এবং গ্যাস সরবরাহ বাড়াতে না পারার পেছনে মূল কারণ হলো প্রযুক্তিগত দুর্বলতা, অভিজ্ঞতার ঘাটতি, বিনিয়োগের সীমাবদ্ধতা এবং নেতৃত্বের অভাব।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম. তামিম বণিক বলেন, “গ্যাস ফিল্ডগুলোর উৎপাদন কমে যাবে এটা পেট্রোবাংলা জানত। উৎপাদন ধরে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি তারা ব্যবহার করতে পারেনি। শেভরন কোম্পানি দীর্ঘ সময় তাদের কূপের উৎপাদন ধরে রেখেছে। এছাড়া বাপেক্সকে দিয়ে কূপ খননে যে পরিমাণ বিনিয়োগ প্রয়োজন ছিল, তা করা যায়নি। গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কার, কূপ খনন, অভিজ্ঞতা, দক্ষতা ও নেতৃত্ব নিশ্চিত করা হয়নি। বিগত সরকার এটি করেনি, বর্তমান সরকারের সময়েও বাপেক্সের কোনো উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন হয়নি। তার প্রভাব গ্যাস উৎপাদনে দেখা যাচ্ছে।”
তিনি আরও বলেন, “গ্যাস উৎপাদন ধরে রাখতে অনেক আগেই প্রস্তুতি নেওয়া উচিত ছিল। ১০ বছর আগে পূর্বাভাস ছিল যে গ্যাস কমে যাবে। তৎকালীন সময় কেন উদ্যোগ নেওয়া হয়নি, তা প্রশ্নবিদ্ধ। প্রাতিষ্ঠানিক নেতৃত্ব দরকার ছিল, যার ওপর ভর করে সরকার বিনিয়োগ করতে পারত। এখন সরকারের পক্ষে সীমাবদ্ধতা আছে, নতুন সরকার এলে কিছু করা সম্ভব হতে পারে।”
দেশে স্থানীয় কোম্পানি হিসেবে আরও দুটি সংস্থা গ্যাস উৎপাদন করছে। সিলেট গ্যাস ফিল্ডে দৈনিক উৎপাদন ১৩৮ মিলিয়ন ঘনফুট। বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি লিমিটেডের উৎপাদন ৪৬২ মিলিয়ন ঘনফুট। এই দুটি সংস্থার কূপ সংখ্যা বাপেক্সের চেয়ে অর্ধেক হলেও উৎপাদন স্থিতিশীল রয়েছে।
পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মাইনস) প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম বলেন, “বাপেক্সের গ্যাস উৎপাদন কমে গেছে এমন নয়। তাদের আবিষ্কৃত বেশ কয়েকটি গ্যাস ফিল্ড পাইপলাইন অবকাঠামোর সংকটে গ্রিডে যুক্ত করা যাচ্ছে না। ভোলায় বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ থাকায় গ্যাস ব্যবহার কম দেখা যাচ্ছে। তাই উৎপাদনও কম দেখাচ্ছে। ক্রমবর্ধমান হার বিবেচনা করলে তাদের উৎপাদন ঠিক আছে।”

