২০২২ সালের দিকে দেশ উচ্চ মূল্যস্ফীতির কবলে পড়ে। সেই সঙ্গে কর্মসংস্থান কমতে শুরু করে। বর্তমানে রাজনৈতিক অস্থিরতায় দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ প্রায় বন্ধ। বিনিয়োগকারীরা অনিশ্চয়তায় ভুগছেন। ফলে নতুন চাকরি হচ্ছে না, বেকারত্ব বেড়েই চলেছে। সাধারণ মানুষ সামাজিক নিরাপত্তাহীনতার শিকার।
কৃষকরা উৎপাদন করলেও তাদের ফসলের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না। এই অবস্থায় বিশ্বব্যাংক একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, দেশে প্রায় ৬ কোটি ২০ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এই সংকট মোকাবিলায় পরিকল্পিত বিনিয়োগ বৃদ্ধির প্রয়োজন। কৃষি খাতে ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা, নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা এবং সামাজিক নিরাপত্তা জোরদার করা জরুরি। এর মাধ্যমে দেশের মানুষ দারিদ্র্য এবং বেকারত্বের চক্র থেকে মুক্তি পেতে পারেন।
২০২৪ সালের শেষ প্রান্তিকে ২১ লাখ মানুষ বেকার:
বিশ্বব্যাংকের ২০১৬ থেকে ২০২২ সালের তথ্য একভাবে বিশ্লেষণ করা ঠিক হবে না। দারিদ্র্য পরিস্থিতি বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন রূপ নেয়। প্রতিবেদনে তিনটি সময়কাল আলাদা করা হয়েছে—২০১০ থেকে ২০১৬, ২০১৬ থেকে ২০২২, এবং ২০২২ থেকে ২০২৫। এই সময়গুলো রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের সময় ছিল এবং ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
২০১০ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত দারিদ্র্য কমে প্রবৃদ্ধি স্থিতিশীল ছিল। কিন্তু ২০১৬ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে শাসনব্যবস্থায় পরিবর্তন আসে। অবকাঠামোগত উন্নয়নের বড় অংশ দখল হয়ে যাওয়ায় সমাজ দুর্বল হয়ে পড়ে। দুর্নীতিকেন্দ্রিক প্রণোদনাব্যবস্থা গড়ে ওঠে। রাজনৈতিক গণতন্ত্রের অবক্ষয় অর্থনৈতিক গণতন্ত্রকেও দুর্বল করে।
২০২২ থেকে ২০২৫ সালের সময়ে পরিস্থিতি আরও উল্টে যায়। পিপিআরসি পরিচালিত গত আগস্টের জরিপে দেখা যায়, ২০২৫ সালে দেশের সার্বিক দারিদ্র্য বেড়ে ২৭.৯৩ শতাংশে পৌঁছেছে। চরম দারিদ্র্যও বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২৪ সালের শেষ প্রান্তিকে ২১ লাখ মানুষ কাজ হারিয়েছে, যার মধ্যে ১৫ লাখ নারী। ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, এই সময়গুলোর বিশ্লেষণ ছাড়া ভবিষ্যতের জন্য সঠিক নীতি গ্রহণ করা সম্ভব হবে না।
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: নির্বাহী চেয়ারম্যান, পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার।
তাড়াতাড়ি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা জরুরি:
২০২২ সালের আগে দেশের অবস্থা তুলনামূলকভাবে ভালো ছিল। মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে ছিল। তখন দারিদ্র্য ও চরম দারিদ্র্যের হার কম ছিল। কিন্তু এরপর দেশ অতি উচ্চ মূল্যস্ফীতির কবলে পড়ে। বিশেষ করে খাদ্যের দাম বৃদ্ধি অল্প আয়ের মানুষকে সরাসরি আঘাত করে।
দীর্ঘ সময় ধরে দেশে বিনিয়োগ প্রায় বন্ধ। উৎপাদন কমে গেছে। কৃষকরা ফসল উৎপাদন করলেও ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না। তাদের ফসল দরদাম বাড়িয়ে ফড়িয়াদের হাতে চলে যাচ্ছে। পরে তা বেশি দামে ভোক্তাদের কিনতে হয়। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন দরিদ্র ও হতদরিদ্ররা। নানা কারণে শিল্প ও কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। মানুষের হাতে নগদ অর্থ কমছে। বিশ্বব্যাংক জানিয়েছে, প্রায় ৬ কোটি ২০ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নামার ঝুঁকিতে রয়েছেন। এই শঙ্কা উপেক্ষা করা যায় না। অর্থনীতিতেও এতে ধাক্কা পড়তে পারে।
মুস্তফা কে মুজেরি বলছেন, তাই যত দ্রুত সম্ভব রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা জরুরি। সামাজিক অস্থিরতাও দূর করতে হবে। অস্থিরতার মধ্যে বিনিয়োগকারী কেউ বিনিয়োগ করছে না। বিনিয়োগকারীরা দেশীয় ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভুগছেন। তিনি বলেন, গ্রহণযোগ্য ও সুষ্ঠু নির্বাচন হলে দারিদ্র্যসীমার ঝুঁকি কমানো সম্ভব। তবে নির্বাচনে কোনো ত্রুটি ঘটলে ভোট কারচুপির অজুহাতে ফেব্রুয়ারির পর আবার দেশ অস্থির হয়ে যেতে পারে।
মুস্তফা কে মুজেরি: সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ, বাংলাদেশ ব্যাংক।
উৎপাদন, কর্মসংস্থান ও আয় বাড়ানো জরুরি:
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ২০১০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ব্যাপকভাবে দারিদ্র্য কমেছে। এ সময়ে ২ কোটি ২০ লাখ মানুষ দারিদ্র্য থেকে মুক্তি পেয়েছেন এবং আরও ৯০ লাখ মানুষ অতি দারিদ্র্য অবস্থা থেকে বেরিয়েছেন। তাদের জীবনমান উন্নত হয়েছে। তবে এই উন্নতি সব জায়গায় টেকসই হয়নি। অনেকেই এখনো ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন। যদি তাদের আয় কমে যায়, অসুস্থতা বাড়ে বা সামাজিক নিরাপত্তা না থাকে, তবে অর্জিত সাফল্য হারিয়ে যেতে পারে।
অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য উৎপাদন, কর্মসংস্থান ও আয় বাড়ানো প্রয়োজন। গুণগত শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। বৈদেশিক বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। এসব করা হলে জনগণের জীবনমান টেকসইভাবে উন্নত হবে।
সম্প্রতি একটি বিনিয়োগ সম্মেলন হয়েছে। তবে অধ্যাপক বলেন, এটি একমাত্র সমাধান নয়। বিনিয়োগ সম্মেলন গতানুগতিক উদ্যোগ, যা প্রতিবছরই অনুষ্ঠিত হয়। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকলে উদ্যোক্তা ও বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগে এগিয়ে আসবেন। তিনি আরও বলেন, কৃষিভিত্তিক শিল্পের উন্নয়ন ঘটানো জরুরি। ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীর জন্য শোভন কাজের ব্যবস্থা করতে হবে। কারিগরি শিক্ষার প্রসার ঘটালে বিশাল জনগোষ্ঠীর জীবনমান টেকসইভাবে উন্নত হবে।
অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান: সম্মাননীয় ফেলো, সিপিডি।

