বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনে জীবনযাত্রার অনেক সংকট দেখা দিয়েছে। দ্বীপের প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছেন। শিক্ষাক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার কারণে পুরুষদের ৬৪ শতাংশ এবং নারীদের ৭৮ শতাংশ নিরক্ষর। প্রায় এক-তৃতীয়াংশ পরিবারের ঘরে শৌচাগারের অভাব রয়েছে। কর্মসংস্থানের সীমাবদ্ধতা সামাজিক অসন্তোষও বাড়াচ্ছে।
এসব তথ্য সম্প্রতি সেন্টমার্টিনের জন্য প্রণীত খসড়া মাস্টারপ্ল্যানে উঠে এসেছে। এই পরিকল্পনায় মূলভাবে অনিয়ন্ত্রিত পর্যটন নিয়ন্ত্রণ, পরিবেশ সংরক্ষণ এবং টেকসই ব্যবস্থাপনার বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। পরিকল্পনাটি গত ২৪ নভেম্বর পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের ওয়েবপোর্টালে উন্মুক্ত করা হয়েছে। সাধারণ মানুষ ও সংশ্লিষ্টরা ২০ ডিসেম্বরের মধ্যে লিখিত মতামত দিতে পারবেন।
দ্বীপের জনসংখ্যা ও অর্থনীতি
মাস্টারপ্ল্যানে দেখা গেছে, সেন্টমার্টিনে ১,৪৪৫টি পরিবার বাস করছে। মোট জনসংখ্যা ৯,৮৮৫ জন, এবং প্রতি পরিবারের গড় সদস্য সংখ্যা ৬.৮৪ জন, যা দেশের গড়ের চেয়ে বেশি। জনসংখ্যার প্রায় ৪২ শতাংশের বয়স ১৮ বছরের নিচে এবং প্রায় ৪৪ শতাংশের বয়স ১৯ থেকে ৪৫ বছরের মধ্যে।
দ্বীপের অর্থনীতি প্রধানত মৎস্য আহরণ ও পর্যটনের ওপর নির্ভরশীল। মৎস্য আহরণ মোট আয়ের ৬১ শতাংশ এবং পর্যটন ৩১ শতাংশ অবদান রাখে। স্থানীয় পরিবারের মাসিক গড় আয় মাত্র ৬,৪৪৮ টাকা, যা জাতীয় গড়ের তুলনায় কম। এছাড়া এই আয়ের অনেকাংশ মৌসুমি, যার কারণে অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা দেখা দেয়।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ড. ফাহমিদা খানম বলেন, “সেন্টমার্টিনে বিরল প্রজাতির জীববৈচিত্র্য রয়েছে। পর্যটক নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সেগুলো রক্ষা করা সম্ভব। জীববৈচিত্র্য সুরক্ষা পেলে দ্বীপের আয়ও নিশ্চিত করা যাবে।”
শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা সংকট
দ্বীপে শিক্ষার সুযোগ সীমিত। এখানে একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়/কলেজ, একটি সরকারি ও দুটি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, একটি উচ্চ-মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং ১৭টি মাদ্রাসা আছে। শিক্ষার হার তুলনামূলকভাবে কম এবং নারী শিক্ষার্থীদের জন্য সুবিধা সীমিত। এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা দিতে হলে ঝুঁকিপূর্ণভাবে মূল ভূখণ্ডে যেতে হয়।
স্বাস্থ্যসেবা ক্ষেত্রেও সীমাবদ্ধতা রয়েছে। একটি হাসপাতাল থাকলেও জনবল ও সেবার মান নিম্ন। অধিকাংশ মানুষ প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য ফার্মেসি ও দূরবর্তী স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভরশীল। এতে বিশেষত গর্ভবতী নারী ও শিশুদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে।
বাসস্থানও চ্যালেঞ্জপূর্ণ—৬৮ শতাংশ কাঁচা ঘরে, ১৭.৪ শতাংশ ঝুপড়ি, ১৩.৭ শতাংশ সেমি-পাকা ঘরে এবং মাত্র ০.৯ শতাংশ পাকা ঘরে বসবাস করছে মানুষ। বিদ্যুৎ মূলত সৌরজাল থেকে আসে, তবে ব্যয় বেশি হওয়ায় সকলের জন্য তা সহজলভ্য নয়।
স্যানিটেশন ও জলবায়ু চ্যালেঞ্জ
দ্বীপে স্যানিটেশনের অবস্থা খুবই সীমিত। ৩০ শতাংশ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ফ্লাশ টয়লেট ব্যবহার করে, ৩৫ শতাংশের কোনো স্যানিটেশন ব্যবস্থা নেই। কেন্দ্রীয় পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা নেই। পানীয় জলের প্রধান উৎস ৭২৭টি অগভীর নলকূপ, কিন্তু পানির মান সর্বত্র এক নয়।
পর্যটনের দ্রুত সম্প্রসারণে অর্থনৈতিক সুযোগ সীমিত। বর্তমানে ১৯০টির বেশি হোটেল ও রিসোর্ট রয়েছে, কিন্তু অর্ধেক মালিক অ-স্থানীয়। ফলে স্থানীয়রা পর্যাপ্ত সুবিধা পাচ্ছে না।
টেকসই উন্নয়ন ও মাস্টারপ্ল্যানের মূল লক্ষ্য
খসড়া মাস্টারপ্ল্যানে দশ বছরের জন্য ২৬টি প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত। এর মধ্যে আছে:
-
টেকসই পর্যটন ব্যবস্থাপনা
-
মৎস্য সম্পদ ও সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ
-
প্রবাল ও প্রবাল-নির্ভর উদ্ভিদ ও প্রাণী সংরক্ষণ
-
স্বাস্থ্যসেবা ও স্যানিটেশন উন্নয়ন
-
ক্ষুদ্রঋণ ও স্থানীয় মানুষের বিকল্প আয়ের সুযোগ
মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী, প্রতিদিন ৫০০–৯০০ জন পর্যটক দ্বীপে যেতে পারবে। পূর্বের পিক সিজনে দিনে ৩,০০০–৭,০০০ পর্যটক আসত। এটি দ্বীপের পরিবেশ রক্ষা ও স্থানীয়দের জীবনমান উন্নয়নে সহায়ক হবে।
পরিবেশ ও নিরাপত্তা
দ্বীপের চারপাশে ১,৭৪৩ বর্গকিলোমিটার এলাকাকে সামুদ্রিক সংরক্ষিত জোন ঘোষণা করা হয়েছে। এতে বিপন্ন প্রজাতির মাছ, হাম্পাক ডলফিন, হোয়েল শার্ক ও কচ্ছপ সুরক্ষিত। নতুন মাস্টারপ্ল্যানে আইনগতভাবে বাধ্যতামূলক পর্যটন ও সংরক্ষণ ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে।
সেন্টমার্টিন বঙ্গোপসাগরে, টেকনাফ উপকূল থেকে ১৩ কিলোমিটার দক্ষিণে এবং মিয়ানমার উপকূলের কাছাকাছি। দ্বীপের সামুদ্রিক ও উপকূলীয় নিরাপত্তা স্থানীয় প্রশাসন ও জাতীয় কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে।
এই মাস্টারপ্ল্যানের মূল উদ্দেশ্য হলো সেন্টমার্টিনকে পরিবেশবান্ধব ও টেকসইভাবে উন্নয়ন করা। দ্বীপের বাস্তুতন্ত্র, জনসংখ্যা কাঠামো, পর্যটন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা—all-এর জন্য দীর্ঘমেয়াদী নীতি ও কার্যকর ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা হবে। স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্ত করে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করলে অর্থনৈতিক সুবিধা ও পরিবেশ সংরক্ষণ একসাথে সম্ভব।

