বিগত সরকারের সময়ে ব্যাংক খাতে অনিয়ম, দুর্বল ব্যবস্থাপনা ও লুটপাটের যে অভিযোগ উঠেছিল—তার প্রভাব এখন পুরোপুরি দৃশ্যমান। ঋণ পরিশোধ না হওয়ায় খেলাপি ঋণ দ্রুত বাড়ছে। ফলে ব্যাংকগুলোর প্রভিশন ও মূলধন ঘাটতি বেড়ে গেছে। আয়যোগ্য সম্পদ কমছে এবং সার্বিকভাবে আয়ও নিম্নমুখী। লাগামহীন খেলাপি ঋণ ব্যাংক খাতের প্রায় সব সূচকে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে, যা পুরো আর্থিক ব্যবস্থাকে ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দিয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, আগের সরকারের সঞ্চিত অনিয়মের দায় এখন অন্তর্বর্তী সরকারকে বহন করতে হচ্ছে। তারা বলছেন, আগামী ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের পর যে নতুন সরকার দায়িত্ব নেবে, তাকে আরও জটিল অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে।
এ অবস্থায় কর্মসংস্থান সৃষ্টি, বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক লক্ষ্যমাত্রা অর্জন আরও কঠিন হয়ে পড়বে। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, ব্যাংক খাতে তারল্য সংকট বাড়লে ঋণ বিতরণ কমে যাবে। এতে সার্বিক অর্থনীতি বড় ধাক্কা খেতে পারে।
অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ বলেন, কর্মসংস্থান তৈরি এখন বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ বিনিয়োগ বাড়ানো ছাড়া কর্মসংস্থান সম্ভব নয়। তিনি অভিযোগ করেন, “বিনিয়োগের জন্য যে বিপুল টাকার প্রয়োজন, তা আগের আওয়ামী লীগ সরকার বিদেশে পাচার করে নিয়ে গেছে। ফলে বেশির ভাগ ব্যাংকের অবস্থা এখন নাজুক। বিনিয়োগের টাকা আসবে কোথা থেকে—এটাই হবে নতুন সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।”
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম বলেন, প্রকৃত খেলাপি ঋণ ৪০ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। কারণ অবলোপন করা ঋণ, নবায়ন করা ঋণ ও আদালতে আটকে থাকা ঋণ হিসাবের বাইরে রাখা হয়েছে। তিনি প্রস্তাব দেন, প্রতিটি ব্যাংকের শীর্ষ ১০ খেলাপিকে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বিচার করতে হবে। তা না হলে দেশ এই সংকট থেকে বের হতে পারবে না।
সূত্র জানায়, মোট ব্যাংকের অর্ধেকই এখন কার্যত খুঁড়িয়ে চলছে। খেলাপি ঋণের ফাঁদে পড়ে এসব ব্যাংক প্রায় পঙ্গু হয়ে গেছে। সমস্যা দুটি—আমানতকারীর টাকা ফেরত দেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে এবং আস্থাহীনতার কারণে নতুন আমানতকারী আসছে না। ফলে এসব ব্যাংক দেশের বিনিয়োগে কোনো অবদান রাখতে পারছে না।
অন্যদিকে কিছু ব্যাংক এখনো সবল থাকলেও অনেক ব্যাংক মাঝারি অবস্থায় রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর যে বিপুল বিনিয়োগের চাহিদা তৈরি হবে, তা পূরণ করার মতো পুঁজি ব্যাংকগুলোতে নেই। বিনিয়োগের আরেকটি বড় বাধা উচ্চ সুদহার। বর্তমানে ঋণের সুদ ১৪ থেকে ১৮ শতাংশ। এ হারে ঋণ নিয়ে ব্যবসা করা অনেকের পক্ষেই সম্ভব নয়।
এ অবস্থায় দুর্বল ব্যাংকগুলো আমানত সংগ্রহে হাহাকার করছে। তারা ১৩-১৪ শতাংশ পর্যন্ত সুদ দিয়ে আমানত নিচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা সতর্ক করে বলেছেন, ভবিষ্যতে এটাই বড় দুর্যোগ তৈরি করবে। কারণ এত উচ্চ সুদের আমানত টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। এসব ব্যাংক থেকে যারা উচ্চ সুদে ঋণ নেবে, তাদের বড় অংশ একসময় খেলাপি হয়ে যাবে। ফলে ব্যাংক খাতের বহু বছরের ভুলের বোঝা নতুন সরকারকে বহন করতে হবে।
খেলাপি ঋণে রেকর্ড বৃদ্ধি
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা যায়, সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা। যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ৩৫ দশমিক ৭৭ শতাংশ। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর গত এক বছর তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৪ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা। চলতি বছরের ৯ মাসেই বেড়েছে ২ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধি পায়।
অবলোপন ও বিশেষ বিবেচনায় নবায়ন করা আরও বিপুল ঋণ রয়েছে, যেগুলো খেলাপির যোগ্য। সব মিলিয়ে খেলাপি ঋণ রেকর্ডে পৌঁছেছে।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার আগে খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। এখন তা সাড়ে ৬ লাখ কোটি টাকার কাছাকাছি।
খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির টাইমলাইন
- গত বছরের জুনে খেলাপি ঋণ ছিল ২ লাখ ১১ হাজার কোটি টাকা। হার ছিল ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ।
- গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর লুটপাটের তথ্য প্রকাশ হতে থাকে। সেপ্টেম্বরে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়ায় ২ লাখ ৮৫ হাজার কোটি টাকা। হার ১৬ দশমিক ৯৩ শতাংশ।
- ডিসেম্বরে তা বৃদ্ধি পেয়ে ৩ লাখ ৪৬ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়ায়। হার হয় ২০ দশমিক ২০ শতাংশ।
- ২০২৫ সালের মার্চে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা। হার ২৪ দশমিক ১৩ শতাংশ।
- জুনে পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে ওঠায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক খেলাপি ঋণের তথ্য প্রকাশ বন্ধ করে দেয়। অভ্যন্তরীণ ব্যবহারের জন্যও তথ্য সীমিত করে।
- বিশেষজ্ঞদের মতে, এই তথ্য প্রকাশ পেলে ব্যাংক খাতের সংকট আরও স্পষ্ট হয়ে যেত।
প্রভিশন ও মূলধন ঘাটতি
খেলাপি ঋণ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রভিশন ঘাটতিও বিপজ্জনক মাত্রায় পৌঁছেছে।
- আগের সরকারের শেষ সময়ে ঘাটতি ছিল ২৫ হাজার কোটি টাকা।
- গত বছরের ডিসেম্বরে তা পৌঁছে যায় ১ লাখ কোটি টাকার ওপরে।
- চলতি বছরের জুনে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩ লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকায়।
- সেপ্টেম্বরে কিছুটা কমে ৩ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা হলেও অবস্থার উন্নতি হয়নি।
এছাড়া মূলধন ঘাটতি বাড়ছে, সম্পদের মান কমছে এবং ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ বাড়ছে। এর ফলে আয় কমে গেছে। প্রায় ৫০-৬০ শতাংশ ব্যাংক বড় ঝুঁকিতে পড়েছে।

