বাংলাদেশে ব্যাংকিং খাতের পুনর্গঠিত, পুনঃতফসিলকৃত ও খেলাপি ঋণসহ মোট ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের পরিমাণ এখন প্রায় সাড়ে ৯ লাখ কোটি টাকায় পৌঁছাতে পারে বলে ধারণা দিয়েছে গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট ।
পিআরআই–এর প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. আশিকুর রহমান গত বুধবার রাজধানীর বনানীতে সংস্থার কার্যালয়ে আয়োজিত “মান্থলি ম্যাক্রোইকনমিক ইনসাইটস (এমএমআই)” সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, “বর্তমানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬.৪ লাখ কোটি টাকা, যা মোট ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের প্রায় ৩৬ শতাংশ। মোট ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ এখন সাড়ে ৯ লাখ কোটি টাকার কাছাকাছি, যা এসব সম্পদ পুনরুদ্ধারের কম সম্ভাবনার ইঙ্গিত দেয়।”
ড. আশিকুর রহমান জানান, উচ্চ খেলাপি ঋণ ব্যাংকিং খাতে ঋণ সংকটের ঝুঁকি তৈরি করছে এবং বিনিয়োগকে দুর্বল করছে। “কমপক্ষে ১৬টি ব্যাংক নতুন ঋণ দিতে অক্ষম হয়ে পড়েছে। এর ফলে বিনিয়োগ কমছে, বেকারত্ব বাড়ছে এবং উন্নয়ন মন্থর হচ্ছে। সবশেষে এটি জিডিপি প্রবৃদ্ধিকে নিচে নামাচ্ছে।” তিনি আরও বলেন, খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার প্রধান চারটি পরিণতি লক্ষ্য করা যায় — উচ্চ সুদহার, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, কম প্রবৃদ্ধি এবং কম বিনিয়োগ। সেপ্টেম্বর–অক্টোবরের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আয়োজিত সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন পিআরআইয়ের চেয়ারম্যান জাইদী সাত্তার। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন পিআরআই–এর প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. আশিকুর রহমান।
ঋণ পরিশোধে ঋণ নিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা:
বেসরকারি খাতে ব্যাংক ঋণ প্রবাহ ব্যাপকভাবে কমে গেছে। অনেক ব্যবসায়ী এখন অন্য ব্যাংকের ঋণ পরিশোধের জন্য নতুন ঋণ নিচ্ছেন। বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, “এভাবে ঋণ নেওয়া হচ্ছে যাতে আগের ঋণগুলো অনিয়মিত বা সাবস্ট্যান্ডার্ড না হয়ে যায়।” তিনি অভিযোগ করেন, “অর্থনীতির রক্তক্ষরণ হচ্ছে, কিন্তু সরকারের কাছে ব্যবসায়ীদের কথার কোনো গুরুত্ব নেই।”
সরকারের তথ্য অনুযায়ী, জুন থেকে আগস্টের মধ্যে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ৭%–এর নিচে নেমে গেছে, যা গত ২২ বছরে সর্বনিম্ন। পারভেজ মনে করেন, এই ঋণ সংকোচন এবং খেলাপি ঋণ বৃদ্ধিই এখন দেশের অর্থনীতির প্রধান ঝুঁকি। সেপ্টেম্বরের শেষ পর্যন্ত ব্যাংকখাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৬.৪৪ লাখ কোটি টাকা। তবে পারভেজ বলছেন, প্রকৃত খেলাপি ঋণ এর চেয়েও বেশি হতে পারে এবং এজন্য সরকারি নীতি দায়ী। আগে ঋণ পুনঃতফসিলের জন্য ঋণগ্রহীতাদের ৬ মাস সময় দেওয়া হতো কিন্তু আগামী মার্চ থেকে সময় কমিয়ে ৩ মাস করা হবে। বিজিএমইএ–এর সাবেক সভাপতি পারভেজ মনে করেন, এই নীতি খেলাপি ঋণ আরও বাড়াবে।
তিনি ব্যবসায়ীদের একার দায়ে ঋণ বৃদ্ধির ধারণাকে অস্বীকার করে বলেন, “বারবার জ্বালানির দাম বাড়ানো হয়েছে, সরবরাহের প্রতিশ্রুতি ছিল কিন্তু তা হয়নি। গ্যাস–নির্ভর শিল্পের উৎপাদন এখন ৪০%–এ নেমে গেছে। এটি কি বেসরকারি খাতের দায়?” পারভেজ আরও উল্লেখ করেন, এনবিআরের নতুন ৫৫ হাজার কোটি টাকার অতিরিক্ত রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ব্যবসার ওপর চাপ বাড়াবে। “আমরা আশঙ্কা করছি, এবার তা উৎসে কর কর্তন বা টিডিএস–এর নামে আসবে, যা উৎপাদন ব্যয় বাড়াবে।” তিনি প্রশ্ন তোলেন, “এত তড়িঘড়ি কেন? যে এনবিআর সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে, তা এনবিআরকে আগের চেয়েও খারাপ অবস্থায় নিয়ে গেছে।”
পিআরআইয়ের চেয়ারম্যান জাইদী সাত্তার বলেন, অর্থনীতির গতি ধীরে হলেও স্থিতিশীলতা এসেছে। কর্মসংস্থান বাড়াতে আরও উদার নীতি প্রয়োজন। তিনি উল্লেখ করেন, পাল্টা শুল্কের প্রভাবে রপ্তানি কিছুটা কমলেও বাংলাদেশ এখনও ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে।

