আগামীর বাংলাদেশে বেকারত্ব সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে উঠতে যাচ্ছে। ইতিমধ্যেই এর প্রভাব লক্ষ্যণীয় হয়ে উঠেছে দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে।
প্রাতিষ্ঠানিক চাকরির সুযোগ না থাকায় ছোট-বড় সব শহরে বেড়েছে ব্যাটারিচালিত রিকশা, ভ্রাম্যমাণ ফেরিওয়ালা ও মোটরবাইক রাইডারদের সংখ্যা। ঢাকার মতো মহানগরের বস্তি এলাকায় চাপ দিনদিন বাড়ছে। বেঁচে থাকার তাগিদে বা একটু বেশি আয়ের আশায় মানুষ গ্রাম থেকে শহরে ছুটে এসেছে।
রাজধানী ঢাকার পরিস্থিতি সবচেয়ে গুরুতর। জাতিসংঘের ‘ওয়ার্ল্ড আরবানাইজেশন প্রসপেক্ট ২০২৫’ প্রতিবেদনে দেখা যায়, ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তার পর ঢাকা এখন ৩.৬৬ কোটি জনসংখ্যা নিয়ে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম জনবহুল মহানগর। ধারণক্ষমতার সীমা ছাড়িয়ে যাওয়ায় ঢাকার পরিবেশ আগেই বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে। সঙ্গে যোগ হয়েছে সীমাহীন যানজট। প্রতিদিন নষ্ট হচ্ছে হাজার হাজার কর্মঘণ্টা। এভাবে চললে ঢাকার নগর জীবন এবং দেশের অর্থনীতি, সামাজিক স্থিতিশীলতা উভয়ই মারাত্মক প্রভাবের মুখে পড়বে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে দেশের বেকারত্ব হার ৪.৬৩ শতাংশে পৌঁছেছে। এটি বিগত বহু বছরের রেকর্ড ভেঙেছে। সেই সময়ে প্রায় ২৭.৪ লাখ মানুষ কর্মহীন ছিলেন। তবে বাস্তবে প্রকৃত বেকারত্বের হার এর চেয়ে অনেক বেশি। উৎসাহজনক বিষয় হলো, দেশের অধিকাংশ মানুষ কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতে চান। গ্রামাঞ্চলের মানুষ অনেক সময় ভিটা-জমি বন্ধক রেখে অথবা ঋণ নিয়ে বিদেশে যান উন্নত জীবনের প্রত্যাশায়। সেখানে তারা প্রচুর পরিশ্রম করে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, দেশে পরিবারকে সাহায্যের জন্য রেমিট্যান্স পাঠান। এই প্রবাসীদের অর্থ পাঠানোই ঘুরিয়ে রাখে দেশের অর্থনীতির চাকা। কিন্তু সব বেকার প্রবাসী হতে পারেন না।
আর্থিক সীমাবদ্ধতা ও নানা কারণে অনেক মানুষই দেশে থেকে বেকার থাকেন। জীবিকার তাগিদে এই বেকার জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ ঢাকার অভিবাসী হতে বাধ্য হন। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার ২০২২ সালের প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাংলাদেশে কর্মজীবীদের ৮৪.৯ শতাংশ বা প্রায় ছয় কোটি মানুষ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করছেন। প্রাতিষ্ঠানিক খাতে পর্যাপ্ত সুযোগ না থাকায় কর্মক্ষম মানুষ বাধ্য হয়ে অপ্রাতিষ্ঠানিক কাজ করছেন।
এই শ্রমিকদের মধ্যে কেউ ধনী হয়েছেন এমন তথ্য নেই। তারা কেবল টিকে থাকার লড়াইয়ে নিমগ্ন। শহরাঞ্চলে অপ্রাতিষ্ঠানিক কর্মজীবীদের অনেকেই বস্তিতে অমানবিক জীবনযাপন করছেন। অন্যরা ফুটপাত, রেলস্টেশন, লঞ্চ টার্মিনাল, বাসস্ট্যান্ড বা মার্কেটের বারান্দায় ভ্রাম্যমাণ জীবন কাটাচ্ছেন। তিনবেলা খাবার জোগানোই তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য। নগরমুখী এই অভিবাসী জনগোষ্ঠী পরিবেশ দূষণ, যানজট, পানি ও বিদ্যুতের ওপর চাপসহ নানা সমস্যা সৃষ্টি করছে। ঢাকাকেন্দ্রিক উন্নয়ন অর্থনীতিকে বিকেন্দ্রীকরণ না করার ফল। নগরবাসী এখন এর নেতিবাচক প্রভাব ভোগ করছেন।
একই সঙ্গে দেশের বেকার সমস্যা বাড়ছে পরিকল্পনার অভাব, দারিদ্র্য, অদক্ষতা, পশ্চাদপদ শিক্ষা ব্যবস্থা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে। বেকারত্ব সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সমীক্ষা অনুযায়ী, ২০২৪ সালে দেশে উচ্চশিক্ষিত বেকারের সংখ্যা প্রায় নয় লাখ। অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে উচ্চশিক্ষিত বেকাররাই সবচেয়ে বেশি লাঞ্ছনার শিকার হচ্ছেন।
সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বাতিলের দাবির কারণে ২০২৪ সালে বাংলাদেশের গণ-অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন দেশের উচ্চশিক্ষিত তরুণরা। তাদের ন্যায্য দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে সাধারণ মানুষও সড়কে নামে। লাখ লাখ মানুষের আন্দোলনে পতন ঘটে একটি ফ্যাসিস্ট সরকারের। জুলাই-২৪ পরবর্তী সময়ে দেশের মানুষের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা বেড়ে গেছে, বিশেষ করে উচ্চশিক্ষিত ভোটারদের মধ্যে। বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, দেশে ভোটারের সংখ্যা ১২.৬১ কোটি। এর মধ্যে নতুন ভোটারের সংখ্যা ৪৫ লাখ। পাশাপাশি কয়েক কোটি ভোটার গত ১৫ বছরে কর্মবাজারে প্রবেশ করেছেন।
এই বিশাল ভোটার জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ গত তিনটি নির্বাচনে ভোট দিতে যাননি। তাদের কাছে একতরফা ভোট ছিল এক প্রহসন ছাড়া কিছুই। তাই তাদের প্রত্যাশা শূন্য ছিল, কিন্তু ক্ষোভ ছিল প্রচুর। বর্তমানে রাজনৈতিক বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। কর্মক্ষম ভোটাররা সম্মানজনক ও অধিক আয়ের কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা চাইছেন। তারা উন্নত জীবনমানের প্রতিশ্রুতি চান। রাজনৈতিক দলগুলোও এখন এই আকাঙ্ক্ষা বুঝতে পারছেন। তাদের নির্বাচনী ইশতিহারে কর্মসংস্থান সৃষ্টিকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে কর্মসংস্থান এখন বড় একটি অনুঘটক হিসেবে কাজ করবে।
রাজনৈতিক অঙ্গনে কর্মসংস্থান সৃষ্টির প্রতিশ্রুতি দেয়া সহজ হলেও বাস্তবায়ন ততটা সহজ নয়। একটি টেকসই, বাজারমুখী ও প্রযুক্তিনির্ভর জাতীয় কর্মসংস্থান মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন এবং বিদ্যমান পদ্ধতির সংস্কার সময়সাপেক্ষ। গবেষণা, সমীক্ষা ও নীতি প্রণয়নে তিন থেকে পাঁচ বছর লাগতে পারে। বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, ঐকমত্য এবং বিশাল বাজেট বরাদ্দ। যুগোপযোগী কর্মসংস্থান পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে গেলে ঔপনিবেশিক আমলের অনেক ধ্যানধারণা ও অচল বন্দোবস্ত পরিবর্তন করতে হবে। এতে কিছু ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তবুও এটি করা বাধ্যতামূলক। বাংলাদেশে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা এবং উন্নয়নের মহাপরিকল্পনা থাকলেও কোনো সমন্বিত কর্মসংস্থান মহাপরিকল্পনা কখনো হাতে নেয়া হয়নি। ফলে দেশের মানবসম্পদের সদ্ব্যবহার হয়নি এবং বেকার সমস্যা এই পর্যায়ে পৌঁছেছে।
বেকার সমস্যা স্থায়ীভাবে দূর করতে প্রথমে আমাদের প্রাক্কলন করতে হবে আগামী ১০ বছরে কোন পেশার চাহিদা থাকবে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লব, রোবোটিকস ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রসারে অনেক চিরায়ত পেশা স্থানান্তরিত হবে। অন্যদিকে প্রযুক্তির কল্যাণে নতুন নতুন পেশা সৃষ্টি হবে। টিকে থাকা এবং ভবিষ্যতের প্রয়োজনীয় পেশাগুলো বিবেচনা করে দেশীয় ও প্রবাসী শ্রমবাজার বিশ্লেষণ করতে হবে। নিরূপণ করতে হবে কোন পেশায় কতজন শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং কী ধরনের দক্ষ কর্মী প্রয়োজন। মোট শ্রমশক্তির চাহিদা অনুযায়ী বাংলাদেশে শিক্ষা ব্যবস্থা সাজাতে হবে। শিক্ষায় থাকতে হবে কেবল জ্ঞানার্জন নয়, বরং প্রতিটি শ্রেণী ও বিষয়ে দক্ষতা অর্জনের সুযোগ। তাত্ত্বিক অংশে ৪০ শতাংশ এবং ব্যবহারিক অংশে ৬০ শতাংশ নম্বর নির্ধারণ করতে হবে। বিশ্বের দক্ষকর্মীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে শিক্ষার্থীরা যেন হাতে-কলমে দক্ষতা অর্জন করতে পারেন, সে বিষয়ে বেশি মনোযোগী হতে হবে।
প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, কারিগরি ডিপ্লোমা, স্নাতক-পাস ও স্নাতক (সম্মান) কোর্স—সবকটিকে কর্মমুখী করার লক্ষ্যে পাঠ্যক্রম পুনর্গঠন করা জরুরি। জীবন ও জীবিকার বুনিয়াদি শিক্ষার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা হবে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি এবং সামাজিক সম্মান বৃদ্ধির ব্যবস্থা নিতে হবে। সহকারী শিক্ষকদের সরকারি দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তা এবং প্রধান শিক্ষককে প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তার মর্যাদা দেওয়া উচিত।
প্রাথমিক শিক্ষা শেষে অনুষ্ঠিত হবে জেএসসি পরীক্ষা। এটি একজন বাংলাদেশী নাগরিকের প্রথম পাবলিক পরীক্ষা হিসেবে গণ্য হবে। সাধারণ, মাদ্রাসা ও ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের জন্য জেএসসি পরীক্ষা সর্বজনীন হবে। জেএসসি সনদ ছাড়া শিক্ষার্থী পরবর্তী শিক্ষাক্রম, সরকারি চাকরি বা প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ গ্রহণ করতে পারবে না। মাধ্যমিক থেকে পিএইচডি পর্যন্ত প্রতিটি পর্যায়ে শিক্ষার্থী মেধার ভিত্তিতে শিক্ষাগ্রহণ ও দক্ষতা অর্জন করবে। উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় ব্যতীত কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হলে পূর্ববর্তী শিক্ষা সনদে ন্যূনতম ৬০ শতাংশ নম্বর থাকা বাধ্যতামূলক হবে।
শিক্ষা ও দক্ষতার মান বৃদ্ধি করতে হলে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ বন্ধ করতে হবে। উচ্চশিক্ষিত বেকারের সংখ্যা কমাতে স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি পর্যায়ে কঠোর মান নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন। উচ্চতর ডিগ্রি শুধুমাত্র মেধাবী, বিশেষজ্ঞ, গবেষক, বিজ্ঞানী এবং কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য থাকবে। সামাজিক সম্মানের জন্য যেকোনোভাবে উচ্চশিক্ষার সনদ পাওয়ার মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। প্রাথমিক থেকে পিএইচডি পর্যন্ত প্রতিটি শিক্ষা পর্যায়ের শেষে শিক্ষার্থীরা তাদের দক্ষতা ও মেধার ভিত্তিতে কর্মসংস্থানের সুযোগ পাবেন। প্রাথমিক শিক্ষার পর সাধারণ ও কারিগরি শিক্ষার অনুপাত হবে ১:২। অর্থাৎ, একটি সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিপরীতে দুটি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থাকা উচিত।
চীনের উদাহরণ এ ক্ষেত্রে নির্দেশক। কারিগরি শিক্ষায় গুরুত্ব দেওয়ায় চীন তাদের দক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করেছে। আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে চায়না বিশ্ব অর্থনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রকে পেছনে ফেলে শীর্ষ স্থান দখল করতে যাচ্ছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে বারবার বিপর্যস্ত হয়ে ও দরিদ্র দেশ হিসেবে ৫০ বছরের মধ্যে চীন কারিগরি জ্ঞান, দক্ষতা ও পরিশ্রম দিয়ে বিশ্ব অর্থনীতির শীর্ষে উঠে এসেছে। বর্তমানে ১৪০ কোটি জনসংখ্যা থাকা সত্ত্বেও চীন ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। চীনের এ সফলতার পেছনে রয়েছে পাঁচ দশক আগে গ্রহণ করা কর্মসংস্থানের মহাপরিকল্পনা। যদিও চীনে গণতন্ত্র নেই, সরকারের সমালোচনার স্বাধীনতা সীমিত এবং মানবাধিকারের প্রশ্ন রয়েছে, তাদের রাজনীতি অর্থনীতি ও কর্মসংস্থানের ঘেরাটোপে আবর্তিত হচ্ছে।
বাংলাদেশেও জুলাই-২৪ পরবর্তী সময়ে মানুষের প্রত্যাশা বহুমাত্রিক। নির্বাচনকালীন ও পরবর্তী সময়ে মানুষের প্রত্যাশা ও প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়নে মিল না হলে রাজনৈতিক দলগুলো জনরোষের মুখোমুখি হবেন। অন্যদিকে দেশব্যাপী ও প্রবাসে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হলে দেশের অর্থনীতির ভবিষ্যৎ চিত্র বদলে যাবে।
সুতরাং, রাজনৈতিক দল যত বেশি বাস্তবনির্ভর কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি দেবেন, তত বেশি ভোটার আকৃষ্ট হবে। নবীন ভোটারদের কাছে কর্মসংস্থান এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনীতির ভবিষ্যৎ পথরেখা অঙ্কিত হবে।

