বিশ্ববাজারে চালের দাম ২০১৭ সালের পর সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমেছে। বিশ্বব্যাংকের ‘কমোডিটি মার্কেট আউটলুক’ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উৎপাদন বৃদ্ধি এবং আমদানিকারক দেশগুলোতে চাহিদা কমার কারণে দাম কমেছে। ২০২৫ সালে বিশ্ববাজারে চালের গড় দাম ৩১ শতাংশ কমেছে। ২০২৬ সালে আরও ১ শতাংশ কমার সম্ভাবনা রয়েছে।
বাংলাদেশেও উৎপাদন বেড়েছে। তবে দেশের বাজারে দাম সেভাবে কমেনি। বরং কিছু ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ পর্যায়েই রয়ে গেছে। খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে যথেষ্ট চাল মজুত রাখা হচ্ছে। বাজারে দাম বেশি থাকায় খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির মেয়াদ পাঁচ মাস থেকে বাড়িয়ে ছয় মাস করা হয়েছে। খোলাবাজারে চাল বিক্রি অব্যাহত আছে। বাজারে দাম না কমলে প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে বেসরকারি পর্যায়ে আমদানির সুযোগও দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন এফপিএমইউ মহাপরিচালক মো. মাহবুবুর রহমান।
সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, গত ১ জানুয়ারি মোটা চালের দাম ছিল প্রতি কেজি ৫০-৫৫ টাকা, যা এখন ৫৪-৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সরু চালের দাম জানুয়ারিতে ছিল ৭০-৮০ টাকা, এখন ৭০-৮৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ফলে দেখা যাচ্ছে, চলতি বছরে বিশ্ববাজারে চালের দাম ৩১ শতাংশ কমলেও বাংলাদেশে দাম কমেনি, বরং বেড়েছে। তবে দেশে নিয়মিত চাল আমদানিও করা হচ্ছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে আমদানি হয়েছে ১৪ লাখ ৩৭ হাজার মেট্রিক টন। আর গত জুলাই থেকে ২৬ নভেম্বর পর্যন্ত আমদানি হয়েছে ৫ লাখ টন।
চাল বাংলাদেশের মানুষের প্রধান খাদ্য। মূল্যস্ফীতিতে চালের প্রভাব সবচেয়ে বেশি। বিটিটিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে গত এক বছরে ধানের দাম বেড়েছে ১১ শতাংশ, সরু চাল ১১ শতাংশ, মাঝারি চাল ১৩ শতাংশ এবং মোটা চাল ৭.৫ শতাংশ। অথচ আন্তর্জাতিক বাজারে একই সময়ে চালের দাম কমেছে ৩৬-৩৭ শতাংশ। ভারত, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এসেছে। বাংলাদেশে এখনো মূল্যস্ফীতির হার চড়া, ৮ শতাংশের বেশি। তবে আগের তুলনায় কিছুটা কমেছে।
এফপিএমইউ মহাপরিচালক মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলেও দেশে সেই অনুপাতে কমেনি। তিনি জানান, কিছুদিন বাজার পর্যবেক্ষণ করে প্রয়োজনে পদক্ষেপ নেওয়া হবে। তিনি আরও বলেন, খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পর্যাপ্ত চাল মজুত রাখা হচ্ছে। বাজারে দাম বেশি থাকায় খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। খোলাবাজারে বিক্রি অব্যাহত আছে। দর বেশি থাকলে প্রয়োজন হলে বেসরকারি পর্যায়ে আমদানির সুযোগ দেওয়া হবে। রাজধানীর বাজারে চড়া দামে চাল বিক্রি হওয়ায় তদারকির অভাব রয়েছে। বাংলাদেশ অটো মেজর ও হাসকিং মিল মালিক সমিতির জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি কে এম লায়েক আলী বিষয়টি উল্লেখ করেছেন।
চালের চাহিদা বেড়েছে:
২০২০ সালের পর থেকেই দেশে চালের দাম চড়া। টিসিবির হিসাবে, ওই বছরের শুরুতে মোটা চালের কেজি ছিল ৩০-৩৫ টাকা। এরপর থেকে দাম ক্রমেই বাড়ছে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার দাম কমানোর চেষ্টা করলেও সফল হয়নি। বর্তমানে বিশ্ববাজারে স্বস্তিকর পরিস্থিতি থাকলেও দেশে দাম কমেনি।
বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের (বিটিটিসি) সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে বছরে চালের চাহিদা ৩ কোটি ৭ লাখ থেকে ৩ কোটি ৯ লাখ টন। স্থানীয়ভাবে উৎপাদন হয় ৪ কোটি ৪৩ লাখ টন। অর্থাৎ চাহিদার চেয়ে উৎপাদন বেশি। তবে এই হিসাব নিয়ে কিছু প্রশ্ন রয়েছে। বিটিটিসির প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, গত এক বছরে দেশে ধানের দাম বেড়েছে ১১ শতাংশ, সরু চালের দাম ১১ শতাংশ, মাঝারি চালের দাম ১৩ শতাংশ এবং মোটা চালের দাম ৭.৫ শতাংশ। অথচ আন্তর্জাতিক বাজারে একই সময়ে চালের দাম কমেছে ৩৬-৩৭ শতাংশ।
বিশ্ববাজার থেকে চাল আমদানি ক্ষেত্রে মার্কিন ডলারের দাম এবং সরকারের নিয়ন্ত্রণ একটি বড় সমস্যা। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, জানুয়ারি থেকে ডলারের দাম ১২২ টাকার আশপাশে রয়েছে। ফলে ডলারের কারণে খরচ বেড়েছে বলাও যায় না। সরকার আমদানি শুল্ক-কর প্রায় সবই তুলে দিয়েছে। তবে আমদানি উন্মুক্ত নয়। চাল আমদানি করতে হলে অনুমতি নিতে হয়। অনুমোদন মিললে তবেই আমদানির সুযোগ থাকে।
ঢাকার মিরপুর-১ নম্বর সেকশনের পাইকারি বাজারের চাল ব্যবসায়ী নাসির উদ্দিন বলেন, মিল পর্যায়ে দাম কমেনি। তাই তাঁরা আগের দামে বিক্রি করছেন। সরকারি ক্রয়ের ক্ষেত্রে বিদেশ থেকে চাল আমদানির খরচও দেখা যায়। ১৬ নভেম্বর সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটির বৈঠকে ভারতের গুরুদেব এক্সপোর্টস করপোরেশন থেকে ৫০ হাজার টন চাল আমদানির অনুমোদন দেওয়া হয়। প্রতি টন চালের দাম ঠিক হয় প্রায় ৩৫৭ মার্কিন ডলার। ফলে প্রতি কেজি দাম পড়ে ৪৩ টাকা ৫৩ পয়সা। এর সঙ্গে ভাড়া ও অন্যান্য খরচ যোগ হবে।
মিলমালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অটো মেজর ও হাসকিং মিল মালিক সমিতির জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি কে এম লায়েক আলী বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমেছে। দেশেও উৎপাদন ভালো হওয়ায় বাজারে দাম কমার কথা। তবে তদারকির অভাবে বাজারে এমন পরিস্থিতি চলছে। এখন সব পর্যায়ে চালের দাম ভিন্ন। মিল কম বা বেশি দামে বিক্রি করলে সরকার যাচাই করতে পারে। লায়েক আলী বলেন, বাজারে দাম বেশি থাকলেও উৎপাদন পর্যায়ে দাম কমেছে। ধানের দামও মণপ্রতি অন্তত ১০০ টাকা কমেছে। এ কারণে মিলগুলো এখন কম দামে বাজারে চাল ছাড়ছে। তবে রাজধানীর বাজারে চড়া দামে বিক্রি হওয়ার বিষয়টিতে তদারকির অভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
সিপিডি গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বিগত বছরগুলোতে চালের উৎপাদন খরচ বেড়েছে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমায় আমিষ গ্রহণ কমেছে। এর ফলে ভাতের চাহিদা বেড়ে গেছে, যা চালের দাম বাড়াতে প্রভাব ফেলছে।
দেশে আয় কম, খাবারে খরচ বেশি:
দেশের স্বল্প আয়ের মানুষদের আয় বড় অংশ খরচ হয় চাল ও খাবারে। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) ‘ইকোনমিক ডায়নামিকস অ্যান্ড মুড অ্যাট হাউসহোল্ড লেবেল ইন মিড ২০২৫’ গবেষণায় বলা হয়েছে, জাতীয় গড় অনুযায়ী একটি পরিবারের মাসিক ব্যয়ের ৫৫ শতাংশের মতো যায় খাবার কেনার পেছনে। দেশে দারিদ্র্য বাড়ছে। কর্মসংস্থানের গতি নেই। মূল্যস্ফীতিও কমছে না। বিশ্লেষকেরা মনে করেন, চালের বাজার নিয়ে এখন বিস্তারিত গবেষণা করা প্রয়োজন। সেই তথ্য অনুযায়ী নীতি ও পদক্ষেপ গ্রহণ করলে কৃষক ও ভোক্তা—দুই পক্ষই সুফল পাবে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বিগত বছরগুলোতে চালের উৎপাদন খরচ অনেক বেড়েছে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমায় আমিষ গ্রহণ কমেছে। তার বিপরীতে ভাতের চাহিদা বেড়েছে, যা চালের বাজারে চাপ সৃষ্টি করছে। উৎপাদনের হিসাবও সবসময় আস্থা রাখার মতো নয়। বাজারে সীমিতসংখ্যক বড় ব্যবসায়ীর ওপর সরকারের নজরদারিতে ঘাটতি আছে। গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, এসব বিষয় নিয়ে একটি বিস্তারিত গবেষণা দরকার। এটি ভবিষ্যতে বাস্তবানুগ নীতিসিদ্ধান্ত নেওয়ায় সহায়তা করবে।

