অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সর্বশেষ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) উন্নয়ন সহযোগীরা যে পরিমাণ বৈদেশিক ঋণ ছাড় করেছে, বাংলাদেশ ঠিক সেইরকম পরিমাণ ঋণ পরিশোধ করেছে।
গতকাল রবিবার (৩০ নভেম্বর) প্রকাশিত প্রতিবেদনে ইআরডি জানায়, জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত উন্নয়ন সহযোগীরা ১.৬৬ বিলিয়ন ডলার ঋণ ছাড় করেছে। এ সময়ে বাংলাদেশ বিভিন্ন ঋণের আসল ও সুদ মিলিয়ে ১.৫৮৫ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করেছে।
একই সময়ে বাংলাদেশ ১.২ বিলিয়ন ডলারের নতুন বৈদেশিক ঋণ চুক্তি করেছে এবং উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে নতুন ঋণ চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। ইআরডির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, চলতি অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর সময়ে গত বছরের একই সময়ে বিদেশি সহায়তার প্রতিশ্রুতি ৩৭৫ শতাংশ বেড়েছে। বৈদেশিক ঋণের অর্থছাড় বেড়েছে ৩৮.৫১ শতাংশ। অন্যদিকে, সুদ ও মূল পরিশোধ বেড়েছে ১০.২৩ শতাংশ।
গত অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর সময়ে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি ছিল মাত্র ২৫৪.৫৭ মিলিয়ন ডলার। একই সময়ে ঋণ অর্থছাড় ছিল ১.২০ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ তখন সুদ ও মূল মিলিয়ে ১.৪৩৭ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করেছিল। ইআরডির কর্মকর্তারা জানায়, চলতি অর্থবছরে ঋণ অর্থছাড় ও উন্নয়ন সহযোগীদের প্রতিশ্রুতি বেড়ে যাওয়ার কারণ, গত বছরের জুলাই-অক্টোবর সময়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের কারণে উন্নয়ন কার্যক্রম ও প্রকল্প বাস্তবায়ন প্রায় স্থবির ছিল। ফলে সেই সময়ে ঋণ অর্থছাড় ও প্রতিশ্রুতি অনেক কমে গিয়েছিল। অন্যদিকে, বিগত বছরগুলোতে নেওয়া বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের ঋণ ও বাজেট সহায়তার গ্রেস পিরিয়ড শেষ হওয়ায় বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ ক্রমবর্ধমান হচ্ছে।
নতুন প্রতিশ্রুতিতে নির্বাচনের প্রভাব:
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, জাতীয় নির্বাচন ঘনিয়ে আসায় বড় উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য নতুন প্রতিশ্রুতির সম্ভাবনা কমে যায়। এতে বাজেট সহায়তা এবং বড় অঙ্কের ঋণও অন্তর্ভুক্ত।
তিনি ব্যাখ্যা করেন, এর মূল কারণ উভয় পক্ষের অনিশ্চয়তা। বড় প্রকল্পের জন্য মন্ত্রণালয়গুলোকে নতুন প্রস্তাব তৈরি করতে হয় এবং আলোচনা ও অনুমোদনের বিভিন্ন ধাপ পেরোতে হয়। নির্বাচন ঘনালে সেই মনোযোগ কমে যায়। মাঠ পর্যায়ে নির্বাচন-সংক্রান্ত দায়িত্ব, তদারকি এবং প্রশাসনিক চাপ প্রকল্প প্রণয়নের সময় ও সক্ষমতা দুটিই সীমিত করে। অন্যদিকে, নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার আগে বড় ঋণ অনুমোদন করতে উন্নয়ন সহযোগীরা দ্বিধাবোধ করে।
জাহিদ হোসেন বলেন, “উন্নয়ন সহযোগীরাও (যেমন বিশ্বব্যাংক, এডিবি) নির্বাচন-পূর্ব সময়কে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করে। তারা প্রশ্ন তোলে, এই সরকার আরও এক মাস থাকবে কি না, নতুন সরকার এ প্রকল্পের মালিকানা নেবে কি না। ফলে অগ্রিম বড় ঋণ অনুমোদনের ক্ষেত্রে তারা সতর্ক থাকে।”
চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও ঋণ ও সহায়তায় ইতিবাচক সংকেত:
পলিসি এক্সচেঞ্জ-এর চেয়ারম্যান ও সিইও মাসরুর রিয়াজ জানিয়েছেন, গত বছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে অর্থনৈতিক ও উন্নয়ন ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। তিনি বলেন, এ বছর আর্থিক ব্যবস্থাপনা, বিদেশি ঋণ ও উন্নয়ন ব্যয়ের ক্ষেত্রে সরকার তুলনামূলকভাবে শক্ত অবস্থানে রয়েছে। মাসরুর রিয়াজ আরও বলেন, “সরকারের রাজস্ব নীতি ও বৈদেশিক সহায়তা ব্যবস্থায় স্পষ্টতা এসেছে।”
তবে তিনি সতর্ক করেন, অনেক উন্নয়ন অংশীদার এখনও নির্বাচনের ফলাফলের দিকে নজর রাখছে। তিনি বলেন, “যখন একটি স্থিতিশীল ও নির্বাচিত সরকার দায়িত্ব নেবে, তখন তারা নতুন নীতিনির্ধারক দলের সঙ্গে আলোচনা করে নতুন প্রকল্প অনুমোদন ও কমিটমেন্ট বাড়ানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।”
অর্থছাড় ও পরিশোধে চলতি অর্থবছরের পরিসংখ্যান:
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে বাংলাদেশ আসল পরিশোধ করেছে ১.০২ বিলিয়ন ডলার। এটি গত অর্থবছরের একই সময়ে ৮৯৫.৫৮ মিলিয়ন ডলারের তুলনায় বেড়েছে।
চলতি সময়ে বিভিন্ন ঋণের সুদ বাবদ বাংলাদেশ পরিশোধ করেছে ৫৬০.৮৭ মিলিয়ন ডলার, যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ৫৪২.৩২ মিলিয়ন ডলার। একই সময়ে এডিবি থেকে সর্বোচ্চ ৫৮১.৭৪ মিলিয়ন ডলার অর্থছাড় এসেছে। বিশ্বব্যাংক ১২.৪৪ মিলিয়ন ডলারের নতুন প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
জুলাই-অক্টোবর সময়ে সব থেকে বেশি অর্থছাড় করেছে রাশিয়া। এই উন্নয়ন সহযোগী ৪০৭.৭৮ মিলিয়ন ডলার ঋণ ছাড় করেছে, যার বড় অংশ রূপপুর বিদ্যুৎ প্রকল্পে ব্যবহার হচ্ছে। এরপর বিশ্বব্যাংক ৪০৫.২৪ মিলিয়ন ডলার, এডিবি ২৪৮.৮১ মিলিয়ন ডলার, চীন ১৯৪ মিলিয়ন ডলার, ভারত ৮৪.৮৫ মিলিয়ন ডলার এবং জাপান ৮০.০৯ মিলিয়ন ডলার ঋণ ছাড় করেছে।

