দেশের উন্নয়ন ধারা জনশক্তিকে কার্যকর মানবসম্পদে রূপান্তর করতে পারছে না। অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি থাকলেও নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে না। বরং চাকরির বাজার ছোট হচ্ছে। শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে শ্রমবাজারের কোনো সঠিক সংযোগ নেই। শাসন ব্যবস্থায়ও এসব ঘাটতি চিহ্নিত করে দূর করার সক্ষমতা দেখা যায় না। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ব্যর্থতার চক্র ভাঙতে হলে আগামী অন্তত ১৫ বছর কর্মসংস্থান তৈরি–কেন্দ্রিক নীতি-কৌশল গ্রহণ করতে হবে।
গতকাল রোববার রাজধানীর গুলশানের সিক্স সিজনস হোটেলে ‘বেকারত্বহীন প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানকেন্দ্রিক নীতি কাঠামো’ শীর্ষক সেমিনারে এসব মত তুলে ধরেন অর্থনীতিবিদ ও গবেষকরা। অনুষ্ঠানটির আয়োজন করে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা র্যাপিড ও জার্মান প্রতিষ্ঠান এফইএস। প্রধান অতিথি ছিলেন পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান। সভাপতিত্ব করেন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মো. সানোয়ার জাহান ভূঁইয়া। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন র্যাপিডের চেয়ারম্যান ড. এম এ রাজ্জাক।
হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, বহুদিন ধরে উন্নয়নকে কেন্দ্র করে দেশে একটি আত্মতুষ্টি চলছিল, যা সাম্প্রতিক গবেষণায় ভুল প্রমাণিত হয়েছে। উন্নয়ন, কর্মসংস্থান ও দারিদ্র্য হ্রাস—সব ক্ষেত্রেই রাষ্ট্র ও সমাজের বিশ্লেষকরা আত্মতৃপ্ত ছিলেন। কিন্তু ২০১৬ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ দুর্নীতিপরায়ণ ও সম্পদশালীদের স্বার্থে পরিচালিত এক ভিশাস ট্রায়াঙ্গেলে আটকে পড়ে। এ সময় কর্মসংস্থানবিমুখ প্রবৃদ্ধি, বৈষম্য বৃদ্ধি এবং বিকৃত শাসনব্যবস্থা প্রকট আকার ধারণ করে।
তিনি বলেন, পিপিআরসি ও বিশ্বব্যাংকের গবেষণা দেখাচ্ছে ২০২২ সাল থেকে দেশে দারিদ্র্য আবার বাড়ছে। ইউনিসেফ ও বিবিএসের তথ্য বলছে, শিশুবিয়ে, প্রজনন হার ও সামাজিক সূচকেও অবনতি হয়েছে। নারী শ্রমশক্তির কমে যাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, শুধু পরিসংখ্যান নয়, কারণের গল্প জানতে হবে—নারীরা কেন কর্মসংস্থান ছাড়ছেন। নিরাপদ পরিবহন পেলে অনেক নারী কাজে ফিরতে আগ্রহী হবে।
শ্রমবাজার, শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়ন নীতির সমন্বয়হীনতাকে বড় ব্যর্থতা হিসেবে উল্লেখ করেন সচিব ড. সানোয়ার জাহান ভূঁইয়া। তিনি বলেন, এটি জাতীয় ব্যর্থতা। শিল্পনীতি, কর্মসংস্থাননীতি, শিক্ষানীতি ও দক্ষতা উন্নয়ন নীতির মধ্যে কোনো সংযোগ নেই, যা বর্তমান সংকটকে আরও তীব্র করেছে। আইএলও বাংলাদেশ অফিসের নতুন কান্ট্রি ডিরেক্টর ম্যাক্স টুনন বলেন, বাজারের চাহিদা অনুযায়ী দক্ষতা উন্নয়ন এখন সবচেয়ে জরুরি। একই সঙ্গে মানসম্মত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক চাকরি সৃষ্টিতেও গুরুত্ব দিতে হবে।
মূল প্রবন্ধে ড. এম এ রাজ্জাক বলেন, বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির ধরন নতুন কর্মসংস্থান তৈরির উপযোগী নয়। বরং কিছু ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান কমছে। তাঁর বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ২০১৩ থেকে ২০২৩ সময়ে কৃষির অংশ জিডিপিতে সাড়ে ১৫ শতাংশ থেকে কমে ১১ শতাংশে নেমেছে। শিল্প খাতের অংশ ২৫ থেকে বেড়ে ৩৪ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। তবু কৃষিতে শ্রম কমেনি। বরং উৎপাদন শিল্পে কর্মসংস্থান ৯৫ লাখ থেকে কমে ৮১ লাখে নেমেছে। তিনি আরও বলেন, ২০১০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে প্রস্তুত তৈরি পোশাক রপ্তানি সাড়ে ১২ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ৪০ বিলিয়ন ডলারে গেছে, কিন্তু কর্মসংস্থান ৪০ লাখের আশপাশেই স্থির। ২০১৬-২০২০ সময়ে দেশে বছরে গড়ে ১২ লাখ নতুন চাকরি তৈরি হলেও প্রয়োজন ছিল ২২ লাখ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য ড. সায়মা হক বিদিশা বলেন, কর্মসংস্থান বাড়াতে উৎপাদনশীলতা, দক্ষতা ও শ্রম অধিকার সুরক্ষার সমন্বয় প্রয়োজন। বিডিজবসের সিইও ফাহিম মাসরুর বলেন, ২০১০ সালে যেখানে সাড়ে তিন লাখ স্নাতক চাকরির বাজারে প্রবেশ করত, এখন তা দাঁড়িয়েছে ১০ লাখে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজগুলো বেকারত্ব তৈরির কারখানায় পরিণত হয়েছে।
বিলসের নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ বলেন, শিল্পখাতে কর্মসংস্থানে স্থবিরতা থাকলেও সেবা খাতে নতুন সুযোগ তৈরি হয়। তাই সেবা খাতকে লক্ষ্য করে কৌশল নেওয়া দরকার। কিন্তু নীতি প্রণয়নে সমন্বয়ের অভাব সমস্যাকে বাড়িয়ে তুলছে।

