বাংলাদেশের কৃষি খাত আবারও বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে। প্রাকৃতিক ও অ-প্রাকৃতিক চাপ ক্রমশ উৎপাদন ক্ষমতা কমাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের তীব্রতা, অনিশ্চিত বৃষ্টিপাত, বেড়ে যাওয়া তাপমাত্রা, অব্যবস্থাপনা এবং যন্ত্রায়নের ধীরগতি মিলিয়ে দেশের কৃষি এখন বহুমাত্রিক সংকটে আছে। ২০৩০-২০৫০ সালের মধ্যে ধানের উৎপাদন সর্বোচ্চ ৮ শতাংশ কমতে পারে। এর ফলে খাদ্য নিরাপত্তায় বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি হবে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) আয়োজিত ‘বাংলাদেশের কৃষি-খাদ্য ব্যবস্থাপনার দৃষ্টিভঙ্গি’ শীর্ষক সেমিনারে এই চিত্র উঠে এসেছে। গতকাল মঙ্গলবার (২ ডিসেম্বর) রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বিআইডিএস কনফারেন্স রুমে সেমিনারটি অনুষ্ঠিত হয়। প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা বিভাগের সচিব এস এম শাকিল আখতার। বিআইডিএসের মহাপরিচালক প্রফেসর একে এনামুল হকের সভাপতিত্বে গবেষণা প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন বিআইডিএসের গবেষণা পরিচালক ড. মোহাম্মদ ইউনুস।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জলবায়ুর মারাত্মক পরিবর্তন বাংলাদেশের কৃষিকে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করছে। তাপমাত্রা বছরে বছরে বাড়ছে। মৌসুমি বৃষ্টিপাত কখনো অতিরিক্ত, কখনো অনিয়মিত। এর ফলে ধান, গম, ভুট্টাসহ প্রধান খাদ্যশস্যের জীবনচক্র ব্যাহত হচ্ছে। শুধু ফসল নয়, মাঠে কাজ করা শ্রমিকরাও তাপমাত্রার সরাসরি প্রভাব অনুভব করছে। দেশের বিভিন্ন জেলায় তাপপ্রবাহের কারণে কৃষি শ্রমঘণ্টা প্রায় ২০ শতাংশ কমেছে। উৎপাদনশীলতা কমেছে, জমি প্রস্তুতে বেশি সময় লাগছে এবং শ্রম ব্যয় দ্রুত বাড়ছে।
এই প্রভাব শুধু কৃষক নয়, পুরো গ্রামীণ অর্থনীতিতেও পড়ছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে শ্রমিক উৎপাদন কমে গেলে ক্রয়ক্ষমতা, বাজার লেনদেন, পরিবহন ও সরবরাহ ব্যবস্থা সবেতেই নেতিবাচক প্রভাব দেখা দেয়। সঙ্গে বন্যা, খরা ও ঘূর্ণিঝড়ের মতো জলবায়ুর দুর্যোগ কৃষিকে আরও অস্থিতিশীল করে তুলছে।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জলবায়ুগত সংকটের পাশাপাশি অ-পরিবেশগত চ্যালেঞ্জগুলোও দেশের কৃষিকে পিছিয়ে দিচ্ছে। যন্ত্রায়নের অগ্রগতি থাকলেও ক্ষুদ্র কৃষকরা এখনো এই প্রযুক্তি পুরোপুরি ব্যবহার করতে পারছেন না। মূলত উচ্চমূল্য, তথ্যের ঘাটতি এবং প্রশিক্ষণের অভাব এ ক্ষেত্রে বড় বাধা। ফলে উৎপাদনশীলতা বাড়লেও মাঠ পর্যায়ে সেই সুবিধা পৌঁছাতে সময় লাগছে বেশি।
দেশের ৮০ শতাংশ কৃষিজমি এখনো একক ফসল, প্রধানত ধান নির্ভর। একক ফসলের ওপর এত বেশি নির্ভরশীলতা অর্থনীতিকে বৈচিত্র্যহীন ও ঝুঁকির মধ্যে রাখে। একটি মৌসুম ব্যর্থ হলে জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তায় সরাসরি প্রভাব পড়ে। সবচেয়ে বড় সংকট দেখা দিচ্ছে বোরো ধানের উৎপাদনে। বিগত কয়েক বছর ধরে কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো সতর্ক করে আসছে, বোরো মৌসুমে উৎপাদন বৃদ্ধির হার স্থবির। নতুন হাইব্রিড, পানি সাশ্রয়ী প্রযুক্তি বা লবণাক্ততা সহনশীল জাত ছাড়া ভবিষ্যতে দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মৌসুমটি মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়তে পারে।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল ও আন্তর্জাতিক জলবায়ুসংক্রান্ত বিশ্লেষণ বলছে, দেশের কৃষিব্যবস্থাকে সুরক্ষিত রাখতে এখনই বহুমাত্রিক পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। এতে ফসল বৈচিত্র্য, আধুনিক কৃষিযন্ত্র, পানি ব্যবস্থাপনার দক্ষতা, গবেষণাভিত্তিক নতুন জাত এবং টেকসই কীটনাশক ব্যবহারে জোর দিতে হবে। অন্যথায়, ২০৫০ সালের মধ্যে খাদ্য উৎপাদন কমার কারণে দেশের খাদ্য নিরাপত্তায় বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি হতে পারে।
অনুষ্ঠানে বিআইডিএসের মহাপরিচালক প্রফেসর একে এনামুল হক বলেন, কৃষিতে মূল্য সংযোজন ১২ থেকে বেড়ে ২৪ শতাংশে পৌঁছেছে। এতে দারিদ্র্য হ্রাসে বিভিন্ন ফসলের সম্মিলিত অবদান শক্তিশালী হয়েছে। তবে ধানের মতো যেসব বাজারে সরকার দাম নিয়ন্ত্রণ করে, সেখানে দারিদ্র্য কমার প্রভাব তুলনামূলকভাবে কম। তিনি আরও বলেন, শ্রমশক্তি বেশি হলেও কৃষকের লাভ সীমিত। ফলে তারা এখন বেশি ঝুঁকছে চুক্তিভিত্তিক চাষে। ইউরিয়া সারের ব্যবহারে স্বাস্থ্যঝুঁকি ও পরিবেশ নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে, যদিও প্রমাণ চূড়ান্ত নয়। এডব্লিউডি প্রযুক্তি কৃষকের খরচ বাড়ায়, ফলে গ্রহণযোগ্যতা কম। জলবায়ু পরিবর্তনও কৃষির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে।
প্রধান অতিথি পরিকল্পনা সচিব এস এম শাকিল আখতার বলেন, “বাংলাদেশের কৃষি তথ্যব্যবস্থায় বড় ধরনের গরমিল রয়েছে। বিবিএস ও খামারবাড়ির তথ্য এক নয়। অথচ এ দুটি প্রতিষ্ঠান একই এলাকার মধ্যে। সঠিক সমন্বয় না থাকায় ফসল উৎপাদনের তথ্যও নির্ভরযোগ্য হয় না। কৃষকের জন্য প্রতিবছর বড় অঙ্কের প্রকল্প নেওয়া হলেও কতগুলো প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়, তা স্পষ্ট নয়। অনেক কৃষি প্রকল্পে খরচ অযথা বাড়ে এবং ফেজ শেষ হওয়ার পর কাজ আর এগোয় না।”

