দেশের বেসরকারি খাতের প্রথম ইসলামী শরীয়াহভিত্তিক বেক্সিমকো গ্রিন সুকুক বন্ডের মেয়াদ ২০৩২ সাল পর্যন্ত বৃদ্ধির সুপারিশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনায় গঠিত ওয়ার্কিং কমিটি।
বেক্সিমকো জানিয়েছে, ২০২৬ সালের ডিসেম্বরে মেয়াদপূর্তিকালে তারা বিনিয়োগকারীদের বন্ডের মূলধন ফেরত দিতে পারবে না। মেয়াদপূর্তিতে সব টাকা ফেরত দেওয়া সম্ভব নয়। এজন্য বন্ডটির মেয়াদ বাড়ানোর সুপারিশ এসেছে। এই প্রস্তাব করেছে সুকুকটির ট্রাস্টি—ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) নেতৃত্বাধীন ২১ সদস্য বিশিষ্ট ওয়ার্কিং কমিটি। তারা প্রস্তাব করেছে, ৩,০০০ কোটি টাকার বন্ডের নতুন ম্যাচুরিটি হবে ২০৩২ সাল। মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাবের পেছনে রয়েছে বেক্সিমকোর সাম্প্রতিক আর্থিক চ্যালেঞ্জ, সুকুকের মাধ্যমে অর্থায়িত তিনটি প্রকল্পের মধ্যে দুইটির দীর্ঘসূত্রতা এবং মূল পরিকল্পনা অনুযায়ী সুকুককে শেয়ারে রূপান্তর করতে ব্যর্থ হওয়া।
শেয়ারে রূপান্তরে ব্যর্থতায় মূলধন বকেয়া:
মূল পরিকল্পনায় প্রতি বছর সুকুক বন্ডের ২০ শতাংশ করে বেক্সিমকো লিমিটেডের শেয়ারে রূপান্তর হওয়ার কথা ছিল। ২০২২ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে মোট ১,৮০০ কোটি টাকার বন্ড ইউনিট কনভার্সন হওয়ার কথা থাকলেও কার্যত হয়েছে মাত্র ৬.৩৬ শতাংশ বা ১৯০ কোটি টাকা।
বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, বিনিয়োগকারীরা রূপান্তরে আগ্রহ দেখাননি। তারা অর্ধ-বার্ষিক ৯ শতাংশ মুনাফা বেশি সুবিধাজনক মনে করেছেন। অন্যদিকে বিএসইসি নির্ধারিত ফ্লোর প্রাইস ১১০.১০ টাকায় শেয়ার আটকে রেখেছে। সেকেন্ডারি মার্কেটে বেক্সিমকোর শেয়ার বর্তমানে ৫৮.৫০ টাকায় লেনদেন হচ্ছে। ফলে শেয়ার রূপান্তর অর্থহীন হয়ে পড়েছে। বেক্সিমকো লিমিটেডের এক কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, “৫ আগস্টের পর গ্রুপের শিল্প-প্রতিষ্ঠানগুলোর যে অবস্থা, তাতে মেয়াদপূর্তিতে মূলধন ফেরত দেওয়া সম্ভব নয়। মেয়াদ ৫ বছর বাড়ালে সব মূলধন ফেরত দেওয়া সম্ভব হবে।” বেক্সিমকোর মালিক সালমান এফ রহমান বর্তমানে বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার রয়েছেন। তবে সুকুক বিনিয়োগকারীদের সুদ বা মুনাফা পরিশোধে কোনো খেলাপি হয়নি।
রাজস্ব আসছে মাত্র একটি প্রকল্প থেকে:
বেক্সিমকো গ্রিন সুকুকের অর্থ দিয়ে তিনটি প্রকল্পে বিনিয়োগ করা হয়েছিল—তিস্তা ও করতোয়া সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র এবং বেক্সিমকো টেক্সটাইলে সম্প্রসারণ। ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু হওয়া তিস্তা সোলার পার্ক ২০২৫ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ১,৬৯৩.৩১ কোটি টাকা রাজস্ব আয় করেছে। এর মধ্যে ১,০৪৪ কোটি টাকা বিনিয়োগকারীদের মুনাফা হিসেবে পরিশোধ করা হয়েছে, এবং ২৪৮.৩৯ কোটি টাকা খরচ হয়েছে পরিচালনার জন্য। বর্তমানে বন্ডের চূড়ান্ত পরিশোধের জন্য সিঙ্কিং ফান্ড ও উদ্বৃত্ত মিলিয়ে ৪০১ কোটি টাকা স্থিতি রয়েছে।
কিন্তু আইসিবি পরিচালিত স্পেশাল পারপাস ভিহিকেলের হিসাব অনুযায়ী, এই ব্যালান্স এবং আগামী এক বছরের আয় দিয়ে মূলধন ফেরত দেওয়া সম্ভব নয়। প্রয়োজনের তুলনায় তহবিল খুবই কম। অন্যদিকে, করতোয়া সোলার পার্ক ২০২৪ সালের জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পর ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং এখনও চালু হয়নি। প্রকল্পটি পুনরায় চালু করতে ১৫০ কোটি টাকা প্রয়োজন।
বেক্সিমকো টেক্সটাইল ডিভিশনে প্রায় ৮০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ থাকা সত্ত্বেও সরকার পতনের পর ব্যাংকিং জটিলতার কারণে কাঁচামাল আনার এলসি খোলা সম্ভব হয়নি। ফলে প্রকল্পটি আংশিকভাবে বন্ধ রয়েছে। ফলে, সুকুক বন্ডের মূলধন ফেরতের একমাত্র ভরসা এখন তিস্তা সোলার পার্কের আয়। তিনটি প্রকল্পের মধ্যে বাকি দুটি কার্যত রাজস্ব উৎপাদনে ব্যর্থ।
প্রকল্প পুনরুদ্ধারের ওপর মেয়াদ নির্ভর করছে মেয়াদ:
বেক্সিমকো গ্রিন সুকুকের মেয়াদ বৃদ্ধির বিষয়টি প্রকল্প পুনরুদ্ধারের ওপর নির্ভর করছে। ওয়ার্কিং কমিটি জানিয়েছে, করতোয়া সোলার প্ল্যান্টে ১৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করলে মেয়াদ ছয় বছর থেকে কমিয়ে পাঁচ বছরও নামিয়ে আনা সম্ভব হবে। এছাড়া, সুকুকের ভিত্তিহার ৯ শতাংশ রাখার সুপারিশ করা হয়েছে।
কমিটি আরও প্রস্তাব করেছে, গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে তিস্তা সোলার প্রকল্পের ৬৫০ একর জমি, পঞ্চগড়ের তেতুলিয়া করতোয়া সোলার প্রকল্পের ১৩০ একর জমি এবং বেক্সিমকো টেক্সটাইলের ৬ তলা বিশিষ্ট স্টিল স্ট্রাকচার ভবন চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত করা হোক। এছাড়া, এসপিভির সুবিধার্থে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি প্রদান এবং চূড়ান্ত পেমেন্টের সময় সিঙ্কিং ফান্ডের আকার বৃদ্ধিসহ কিছু শর্ত পরিবর্তনের সুপারিশ করা হয়েছে।
বর্তমানে মেশিনারিজ ও অন্যান্য সম্পদ বন্ধক রাখা হলেও প্রকল্পের জমি ও টেক্সটাইল ইউনিটের জমি বন্ধক রাখা হয়নি। মেয়াদপূর্তিতে বিনিয়োগকারীদের মূলধন ফেরত দেওয়া সম্ভব না হওয়ায় লিজ ডিড সংশোধন করে এসব জমি আইসিবির এসপিভি ইউনিটের আওতায় আনার সুপারিশ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক এই প্রস্তাবগুলো পর্যালোচনা করে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা—বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)-এর কাছে চূড়ান্ত সুপারিশ করবে। এরপর কমিশন বন্ডের মেয়াদ বাড়ানো বা টার্ম অ্যান্ড কন্ডিশন পরিবর্তনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।
বিএসইসি মুখপাত্র আবুল কালাম জানিয়েছেন, কোনো বন্ডের মেয়াদপূর্তি, রি-পেমেন্ট বা টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশনে পরিবর্তন করতে কমিশনের অনুমতি প্রয়োজন। ট্রাস্টি বা অর্জিনেটর কমিশনের কাছে সময় বৃদ্ধির জন্য আবেদন করতে পারে। তবে বেক্সিমকো সুকুকের মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য এখনও কোনো আবেদন আসেনি। জুলাইয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের উচ্চ পর্যায়ের প্যানেলের নির্দেশে গঠিত কমিটিতে বিএসইসি, আইসিবি, ব্যাংকের প্রতিনিধি ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের প্রতিনিধিরা রাখা হয়েছে।
মেয়াদ বৃদ্ধিতে বিনিয়োগকারীদের ভিন্নমত:
সুকুকের ১২.০৬ শতাংশ ইউনিটধারী আইএফআইসি সিকিউরিটিজ জানিয়েছে, তারা মেয়াদ বাড়াতে আপত্তি করছেন না। তবে মুনাফার হার ২ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে। আইএফআইসি ব্যাংকের মুখপাত্র ও আইএফআইসি সিকিউরিটিজের পরিচালক রফিকুল ইসলাম বলেন, “বন্ডের মেয়াদ বৃদ্ধিতে কোনো আপত্তি নেই। তবে যেহেতু বিনিয়োগ করা হয়েছে, সময় বৃদ্ধি করলে সুদের হার ২ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব করেছি। আশা করি, সংশ্লিষ্টরা বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ বিবেচনা করবেন।” বেক্সিমকোর এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানান, করতোয়া প্রকল্প পুনরায় চালু এবং টেক্সটাইল ইউনিট পুনরুদ্ধারে বিদেশী বিনিয়োগ আনার চেষ্টা চলছে। তিনি বলেন, “ছয় বছরের মেয়াদ বাড়ানো হলে পুরো মূলধন ফেরত দেওয়া সম্ভব হবে।
এক নজরে বেক্সিমকোর ৩০০০ কোটি টাকার সুকুক:
বেক্সিমকো দেশের বেসরকারি খাতের প্রথম অ্যাসেট ব্যাকড কর্পোরেট শরীয়াহভিত্তিক সুকুক ইস্যু করে ৩,০০০ কোটি টাকা উত্তোলন করেছে। বন্ডটিতে প্রাইভেট প্লেসমেন্ট অফারের মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যাংক ও তাদের সবসিডিয়ারির মাধ্যমে ২,৪৩৯ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। বাকি ৫৫৮ কোটি টাকা উত্তোলন করা হয়েছে প্রাথমিক গণপ্রস্তাব বা আইপিও’র মাধ্যমে।
প্রকল্পভিত্তিক বরাদ্দ ও বাস্তবায়ন:
-
তিস্তা সোলার প্ল্যান্ট: বরাদ্দ ১,৮৮৬.৮৩ কোটি টাকা, বাস্তব ব্যয় ২,১৫৫ কোটি টাকা।
-
করতোয়া সোলার প্রকল্প: বরাদ্দ ৩০৮.৩১ কোটি টাকা, ব্যয় মাত্র ৩৯ কোটি টাকা।
-
বেক্সিমকো টেক্সটাইল ইউনিট সম্প্রসারণ: বরাদ্দ ৮০৫ কোটি টাকা, ব্যয় ৮০৬ কোটি টাকা।
তিস্তা সোলার প্ল্যান্ট ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু করেছে। ২০২৫ সালের অক্টোবর পর্যন্ত এই প্রকল্প থেকে ১,৬৯৩.৩১ কোটি টাকা রাজস্ব এসেছে। এর মধ্যে ১,০৪৪ কোটি টাকা মুনাফা হিসেবে বিনিয়োগকারীদের পরিশোধ করা হয়েছে, এবং ২৪৮.৩৯ কোটি টাকা খরচ হয়েছে পরিচালনার জন্য। অন্যদিকে, ৩০ মেগাওয়াট সক্ষমতার করতোয়া সোলার প্ল্যান্টের উৎপাদন ২০২৬ সালের জুনে শুরু হওয়ার কথা থাকলেও ২০২৪ সালের আগস্টে আগুনে ট্রান্সফরমার ও সাইট অফিস ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রকল্পটি পুনরায় চালু করতে ১৫০ কোটি টাকা প্রয়োজন।
বেক্সিমকো টেক্সটাইল ইউনিটে প্রায় ৮০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হলেও সরকার পতনের পর ব্যাংকিং জটিলতার কারণে কাঁচামাল আনতে এলসি খোলা সম্ভব হয়নি। ফলে প্রকল্পটি আংশিকভাবে বন্ধ রয়েছে। তিস্তা সোলার পার্কের আয় এখন একমাত্র ভরসা।

