গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বহুদিন চাপা থাকা খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র সামনে আসতে শুরু করেছে। দেশের ব্যাংকিং খাতে রেকর্ড পরিমাণ খেলাপি ঋণ কমাতে বাণিজ্যিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের (এমডি) ঋণ পুনর্গঠন ও আংশিক অবলোপন সুবিধা কাজে লাগানোর পরামর্শ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
গতকাল ৭ ডিসেম্বর ব্যাংকার্স সভায় এমডিদের সঙ্গে বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর খেলাপি ঋণ আদায়ে জোরদার ব্যবস্থা নেওয়ার ওপর জোর দেন। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬.৪৪ লাখ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৩৫.৭৩ শতাংশ। মাত্র কয়েক মাস আগেও এই চিত্র এত ভয়াবহ ছিল না।
সরকারের পতনের আগে গত জুনে খেলাপি ঋণ ছিল ২.১১ লাখ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ১২.৫ শতাংশ। গত বছরের ডিসেম্বরে এ পরিমাণ ছিল ৩.৪৫ লাখ কোটি টাকা বা ২০.২০ শতাংশ। গত ৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকগুলোকে আদায়ের সম্ভাবনা কম এমন মন্দ ও ক্ষতিজনক শ্রেণির ঋণ আংশিক অবলোপনের অনুমোদন দেয়। এতে ব্যালান্স শিটে খেলাপি ঋণের চাপ কিছুটা কমবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম বলেন, ঋণগ্রহীতা ও ব্যবসায়ীদের আর্থিক কাঠামো পুনর্গঠনে নীতি সহায়তা সার্কুলারগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়নের নির্দেশ দিয়েছেন গভর্নর। তিনি জানান, যেসব ঋণের আদায়ের সম্ভাবনা ক্ষীণ সেগুলো আংশিক অবলোপনের বিষয়ে গভর্নর বিশেষ পরামর্শ দিয়েছেন।
সভায় থাকা এক বেসরকারি ব্যাংকের এমডি জানান, যেসব গ্রাহক পুনঃতফসিল করতে চান তাদের নীতিমালা অনুযায়ী সুবিধা দেওয়ার পরামর্শ দেন গভর্নর। সেই সঙ্গে কৃষি খাতে দীর্ঘদিনের বৈষম্যের কথাও তুলে ধরেন তিনি। গভর্নর বলেন, দেশের জিডিপিতে কৃষির অবদান ১৪–১৫ শতাংশ হলেও মোট ঋণের মাত্র ২ শতাংশ যায় এ খাতে। তিনি কৃষি ঋণ ১০ শতাংশের বেশি করার পরামর্শ দেন।
গভর্নর এসএমই ও সিএমএসএমই খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর নির্দেশ দেন। সিএমএসএমই ঋণের জন্য প্রভিশনিং ১ শতাংশ থেকে কমিয়ে ০.৫ শতাংশ করারও আশ্বাস দেন তিনি। সভায় একজন ব্যাংকপ্রধান ব্যক্তিগত ঋণ সীমা বাড়ানোর পুরোনো প্রস্তাবের অগ্রগতি জানতে চান। প্রস্তাবে ব্যক্তিগত ঋণ ২০ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪ কোটি টাকা এবং ক্রেডিট কার্ডের সীমা ২০ লাখ থেকে ৪০ লাখ টাকা করার কথা ছিল। গভর্নর জানতে চান কেন এসব প্রস্তাব এগোয়নি।
দীর্ঘমেয়াদি পুনঃতফসিল সুবিধা অনুমোদন করা হলেও খেলাপি ঋণ বাড়ছে। ব্যাংকগুলো এ সুবিধা বাস্তবায়নে আগ্রহী নয় বলে অভিযোগ উঠেছে। ব্যাংকারদের দাবি, দুই বছরের গ্রেস পিরিয়ড ও মাত্র ১–২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দীর্ঘমেয়াদি পুনর্গঠনের জন্য নিরাপদ নয়। এতে আমানত ঝুঁকিতে পড়ে এবং ঋণ আদায় কঠিন হয়। তারা অভিযোগ করেন, অনেক প্রভাবশালী ঋণগ্রহীতা অনুমোদন পাওয়ার পর আর ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনায় বসেন না।
অন্যদিকে ব্যবসায়ীরা দাবি করেন, অনুমোদন পাওয়ার পরও ব্যাংক সহযোগিতা করছে না। আগের পুনঃতফসিলকারীরা বাড়তি চাপের মুখে পড়ছেন। ফলে স্কিমটি উল্টো ব্যর্থ হয়ে নতুন খেলাপি বাড়ছে। ব্যবসায়ীরা মনে করেন, বাংলাদেশ ব্যাংক হয়তো ব্যাংকগুলোকে বাধ্য করতে চাইছে, কিন্তু নীতিগত ত্রুটি ঠিক না হলে পুনঃতফসিল কার্যকর হবে না এবং খেলাপিও কমবে না।

