বাংলাদেশ স্পেশাল ইকোনমিক জোনে (বিএসইজেড) সুমিতোমো করপোরেশনের সংখ্যাগরিষ্ঠ মালিকানা জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী হিসেবে অভিহিত করেছে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)। বিভাগের মতে, সরকারের অর্থায়নে ভূমি অধিগ্রহণ ও অবকাঠামো উন্নয়ন শেষ হলেও—জোন পরিচালনা বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হাতে ছেড়ে দেওয়া যুক্তিসঙ্গত নয়।
গত ১৪ অক্টোবর ইআরডি অর্থ উপদেষ্টাকে পাঠানো একটি চিঠিতে প্রকল্প সম্প্রসারণের বিরোধিতা জানিয়ে ভবিষ্যতে জোনের বৃদ্ধির আগে স্বাধীন তদন্তের সুপারিশ করেছে। ইআরডি ও বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) সূত্রে জানা যায়, ভূমি উন্নয়নের জন্য সরকার বৈদেশিক ঋণ ব্যবহার করেছে। পরে বিএসইজেডকে একটি প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানিতে রূপান্তর করা হয়। সেখানে জাপান সরকার মনোনীত সুমিতোমোর মালিকানা ৭৬ শতাংশ এবং বেজার ২৪ শতাংশ। কোম্পানিটি পরিচালনার জন্য তিন সদস্যের বোর্ড গঠন করা হলেও বেজার প্রতিনিধি মাত্র একজন। মূল নেতৃত্ব ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ ক্ষমতা সুমিতোমোর হাতে রয়েছে।
এছাড়া, ২০২২ সালের ১ আগস্ট জাইকা অ্যাকসেশন ডিডের মাধ্যমে সুমিতোমোর অংশীদারিত্ব থেকে ১৫ শতাংশ শেয়ার অধিগ্রহণ করে বোর্ডে অভজার্ভার স্ট্যাটাস পেয়েছে। নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে অবস্থিত এ অর্থনৈতিক অঞ্চলটি জাপানি ইকোনমিক জোন নামেও পরিচিত। বর্তমানে এখানে মাত্র আটটি কোম্পানি কার্যক্রম চালাচ্ছে, যার মধ্যে বাংলাদেশের সিঙ্গার কোম্পানিও রয়েছে।
ইআরডির চিঠিতে প্রশ্ন তুলেছে, বাংলাদেশ সরকার ঋণ নিয়ে নিজ দেশে ভূমি অধিগ্রহণ করে কেন বিদেশি বেসরকারি কোম্পানিকে বিএসইজেডের ৭৬ শতাংশ মালিকানা দিয়েছে। স্পষ্ট ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। চিঠিতে বলা হয়েছে, এটি যেন পূর্ববর্তী সরকারের রাজনৈতিক ইচ্ছার প্রতিফলন।
চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, কোম্পানির আর্টিকেলস অব অ্যাসোসিয়েশন, ২০২২ সালের অ্যাকসেশন ডিড এবং ভূমির লিজ চুক্তি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এমন অসম চুক্তির মাধ্যমে যদি অর্থনৈতিক অঞ্চল পরিচালনা বিদেশি কোম্পানির হাতে থাকে, তা জাতীয় স্বার্থের বিপরীতে হবে। তাই ভবিষ্যতে জোন সম্প্রসারণের আগে মালিকানা ও পরিচালনার বিষয়ে স্বাধীন তদন্ত জরুরি। ইআরডির জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা জানান, অর্থ উপদেষ্টার সম্মতি নিয়ে বেজাকে উদ্বেগ জানানো হয়েছে। বিএসইজেড গঠন ও শেয়ার বরাদ্দের যৌক্তিক ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে। ব্যাখ্যা পাওয়ার পর প্রকল্প সম্প্রসারণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
বেজার চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী বলেন, “একবার কোনো চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে ‘নীতিগত ধারাবাহিকতা’ বা পলিসি কনটিনিউটির কারণে অনেক ক্ষেত্রে কিছু করার সুযোগ থাকে না। চুক্তিটি পরিবর্তন করার বা বাতিল করার বাস্তব সুযোগ নেই। চুক্তির নিরপেক্ষতা বা সমতা—যা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে—সেটা খুব আপেক্ষিক। তখন যা সমান মনে হয়েছিল, আজ সেটা নাও হতে পারে।”
চেয়ারম্যান আরও বলেন, “চুক্তির নায্যতা বা সমতার বিষয়ে আমি মন্তব্য করতে চাই না। কারণ, ওই সময় আমি চেয়ারম্যান ছিলাম না। তবে এখন অবশ্যই সরকারের এ ধরনের চুক্তি একটি স্বাধীন বা নিরপেক্ষ সংস্থা দ্বারা পর্যালোচনা করা যেতে পারে। মূল্যায়নের সময় অবশ্যই আলোচনার সময়ের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিতে হবে।”
আশিক চৌধুরী বলেন, দেশে যেসব অর্থনৈতিক অঞ্চল আছে—তার মধ্যে বিএসইজেডে সবচেয়ে ভালো অবকাঠামো হয়েছে। এটি সম্পূর্ণভাবে জাপানি অংশীদারের কৃতিত্ব। তিনি আরও বলেন, “দীর্ঘ আলোচনার পর চুক্তিটি সম্পন্ন হয়েছিল। চুক্তি কোন প্রেক্ষাপট ও ভিত্তিতে করা হয়েছিল, তা তখনকার সংশ্লিষ্ট পক্ষই ভালো বলতে পারবে। আমি ধরে নিচ্ছি সব পক্ষ সদিচ্ছা নিয়ে কাজ করেছেন।”
বেজার সাবেক নির্বাহী চেয়ারম্যান পবন চৌধুরী বলেছেন, অধিক শেয়ার মানেই সব সময় ভালো চুক্তি হয় না। বরং জাপানের ২৪ শতাংশ গুণগত মানসম্পন্ন অংশীদারিত্বই বেশি মূল্যবান প্রমাণিত হয়েছে। তিনি জানান, আলোচনার সময় জাপান বাংলাদেশকে মিয়ানমার, ভারত ও ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে তুলনা করেছিল। তালিকায় বাংলাদেশ ছিল চতুর্থ। কিন্তু শক্তিশালী আলোচনার মাধ্যমে শেষ পর্যন্ত প্রকল্পটি বাংলাদেশ পেয়েছে।
পবন চৌধুরী বলেন, প্রকল্পের জমি বিক্রি করা হয়নি, বরং লিজ দেওয়া হয়েছে। জাপানি অংশীদার নিজের খরচে জমি উন্নয়ন করেছে। ফলে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ একটি সম্পূর্ণ ডেভেলপড সাইট পাবে। বাংলাদেশের অংশীদারিত্ব এসেছে জমির ভাড়ার সমমূল্যের হিসাব থেকে। অন্যদিকে, ঋণের অংশগুলো ঋণ হিসেবেই ফেরত দিতে হবে। তিনি এও বলেন, জাপানি ইকোনমিক জোন এখন দেশের সবচেয়ে সফল ও দৃশ্যমান এফডিআই প্রকল্প। প্রকল্পটি মূলত পিপিপি মডেলের মতো কাজ করেছে। জাইকার বিনিয়োগ ও জাপান সরকারের অবদান এতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
বিপরীতে চীন সমর্থিত অর্থনৈতিক অঞ্চলে এখনো তেমন অগ্রগতি নেই। তুলনা করলে পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে। পবন চৌধুরী আরও বলেন, প্রকল্প প্রক্রিয়ায় বেজা, ইআরডি, পরিকল্পনা কমিশন ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়—সবই যুক্ত ছিল। তাই এটি একটি সম্মিলিত দায়িত্ব।
জাপানি বিনিয়োগ বাড়াতে জাইকা ফরেন ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট প্রমোশন প্রজেক্ট (এফডিআইপিপি) অর্থায়ন করছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ০.০১ শতাংশ সুদে ৪৬১.৬২ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে ৩০ জুন ২০২৫-এর মধ্যে প্রথম নন-এডিপি পর্যায় সম্পন্ন করেছে। এ অর্থ বিনিয়োগকারীদের ঋণ প্রদানে ব্যবহার হয়েছে।
একই ঋণ–চুক্তির আওতায় বেজা বাস্তবায়ন করছে “নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে জাপানি অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের জন্য অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প”। প্রকল্পের জন্য ২০১৯ সালের ২৯ মে ২১,১৭৪ মিলিয়ন জাপানি ইয়েনের আলাদা ঋণচুক্তি সই হয়। ঋণের সুদহার ০.০১ শতাংশ। প্রকল্পের মেয়াদ নির্ধারিত হয়েছিল মার্চ ২০১৯ থেকে ৩০ জুন ২০২৫ পর্যন্ত। তবে অর্থছাড়ের শেষ সময় ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৮ পর্যন্ত বহাল রয়েছে।
জোনটি ধাপে ধাপে ১,০০০ একর এলাকায় গড়ে তোলা হচ্ছে। প্রথম পর্যায়ের ৫০০ একর জমিতে উন্নয়নকাজ শেষ হয়েছে এবং হস্তান্তর প্রক্রিয়ায় রয়েছে। পরবর্তী ৫০০ একরের উন্নয়নকাজ অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। বেজা প্রকল্পের সময়সীমা দুই বছর বাড়িয়ে ৩০ জুন ২০২৭ পর্যন্ত করার প্রস্তাব দিয়েছে। কিন্তু ইআরডি এতে আপত্তি জানিয়েছে। তারা বলেছে, প্রকল্প সম্প্রসারণের আগে অগ্রগতি, ব্যয়ের কাটছাঁট ও বাস্তবায়ন চ্যালেঞ্জের পূর্ণাঙ্গ পর্যালোচনা করা প্রয়োজন।
প্রকল্পের খরচ কমানো সত্ত্বেও অগ্রগতি ধীর। দ্বিতীয় সংশোধনের প্রস্তাবে বেজা চেয়েছে জাইকার বরাদ্দ ২,১২৭.৮২ কোটি টাকা থেকে কমিয়ে ২৩৯.৫৫ কোটি টাকায় নামিয়ে আনতে। ৩০ জুন ২০২৫ পর্যন্ত প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি মাত্র ৩৫.৭৮৫ শতাংশ, আর বাস্তব অগ্রগতি ৬০ শতাংশ—যা নির্ধারিত লক্ষ্য থেকে অনেক পিছিয়ে। পরিকল্পনা কমিশনের ২১ আগস্ট ২০২৫ সালের সভায় সুপারিশ করা হয়েছে, দ্বিতীয় সংশোধনের আগে অব্যয়যোগ্য অর্থ ফেরত প্রদান ও ইআরডির সম্মতি নেওয়া আবশ্যক।
নারায়ণগঞ্জের জাপানি অর্থনৈতিক অঞ্চলের প্রথম পর্যায় নির্ধারিত সময়ে সম্পন্ন হলেও পূর্ণাঙ্গ অর্থনৈতিক অঞ্চল এখনও চালু হয়নি। এই অবস্থায় বেজা দুই বছরের মেয়াদ বৃদ্ধি প্রস্তাব দিয়েছে। কিন্তু ইআরডি বলেছে, প্রথম পর্যায়ের ঋণের অতিরিক্ত সস্তা অর্থ (০.০১% সুদ) ব্যবহার হয়নি, অথচ দ্বিতীয় পর্যায়ে তুলনামূলক উচ্চ সুদে ঋণ নেওয়া যৌক্তিক নয়।
জাইকা ইতোমধ্যে এফডিআইপিপি দ্বিতীয় পর্যায় প্রকল্পকে চলতি অর্থবছরের অনুমোদনযোগ্য প্রকল্প তালিকায় রেখেছে। ১৬ অক্টোবর ২০২৫ তারিখে ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং মিশনের সমাপনী বৈঠকে সংস্থাটি ২০২৬ সালের মার্চের মধ্যে নতুন ঋণচুক্তি সইয়ের তাগিদ দেয়।
ইআরডির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এফডিআইপিপির প্রথম পর্যায়ে ২৪০ কোটি টাকা অব্যহৃত থাকলেও—নতুন প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রায় ৪,৭০৩ কোটি টাকা ঋণ দিতে চায় জাইকা। প্রস্তাবিত সুদের হার ২.৩৫ শতাংশ। ইআরডি বলেছে, প্রথম পর্যায়ের অবকাঠামো কেন এখনও চালু হয়নি, অব্যয়িত ঋণ ফেরত দেওয়ার প্রয়োজন কেন, এবং নতুন উচ্চ সুদের ঋণ নেওয়ার যৌক্তিকতা কী—এসব বিষয় না জানার অবস্থায় মেয়াদ বৃদ্ধি বা নতুন ঋণচুক্তি অনুমোদন করা যাবে না।
জাইকার বক্তব্য:
সুমিতোমোর বিএসইজেড-এ সংখ্যাগরিষ্ঠ শেয়ার নিয়ে ইআরডির উদ্বেগ এবং জাইকার অবস্থান জানতে, দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড জাইকা বাংলাদেশের প্রধান প্রতিনিধি ইচিগুচি তোমোহিদেকে ইমেইল পাঠায়। ইমেইলে জানতে চাওয়া হয়, প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৫ সালের জুনে শেষ হলেও কি বাড়ানো হবে, এবং পরবর্তী ধাপে সুদের হার সাম্প্রতিক আলোচনার মতো ২ শতাংশের কাছাকাছি উঠবে কি না। ইচিগুচি জানান, উল্লিখিত প্রকল্পগুলো এখনো বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে আলোচনাধীন। তাই এই পর্যায়ে জাইকা নির্দিষ্ট মন্তব্য করতে পারছে না।

