শীতলক্ষ্যার ঘন কুয়াশা ভেদ করে নদীর মাঝ বরাবর যখন কদমরসুল সেতুর ‘টেস্ট পাইলিং’ নামানো হচ্ছিল, চারেরগোপের ঘাটে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষজন মুখে বলছিলেন, ‘অবশেষে কাজ শুরু হলো।’ বহু দফা ঘোষণা, স্থগিতাদেশ, জমি অধিগ্রহণ জটিলতা ও প্রশাসনিক জট কাটিয়ে সেতু নির্মাণের কাজ শুরু হওয়াকে স্থানীয়রা অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ মোড়বদল হিসেবে দেখছেন।
২০১৭ সালে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে আলোচনার পর ২০১৮ সালে একনেকে প্রকল্প অনুমোদিত হয়। তবে বাস্তব কাজ দীর্ঘদিন স্থগিত থাকায় প্রকল্প প্রাথমিকভাবে এগোয়নি। সংশ্লিষ্টরা জানান, জমি অধিগ্রহণ, দরপত্র এবং মামলাজটের কারণে কয়েক বছর প্রকল্পের অগ্রগতি থেমে ছিল। চলতি বছরের ১৩ জুলাই ওয়ার্ক অর্ডার জারির পর সাইট ক্লিয়ারিং শুরু হয়। ৩ ডিসেম্বর টেস্ট পাইলিংয়ের মাধ্যমে নির্মাণ কার্যক্রমে গতিশীলতা এসেছে।
স্থানীয় ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তারা সেতুর ভূমিকাকে অর্থনৈতিক পরিবর্তনের ‘চেঞ্জমেকার’ হিসেবে দেখছেন। এলজিইডির প্রকৌশলীরা জানিয়েছেন, টেস্ট পাইলিং শেষ হলে মূল পাইলিং শুরু হবে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আশাবাদী, সময়মতো বরাদ্দ ও অনুমোদন পেলে কয়েক বছরের মধ্যে সেতুর মূল কাঠামো দৃশ্যমান হবে।
শীতলক্ষ্যা নদী পার হওয়া বন্দর-নারায়ণগঞ্জের মানুষের দীর্ঘদিনের ভরসা ছিল নৌপথ। কিন্তু সময়, যাতায়াত বিভ্রাট ও ব্যবসায়িক অনিশ্চয়তা বিনিয়োগকারীদের চাপের মধ্যে ফেলেছে। শিল্প মালিকরা আশা করছেন, সেতু নির্মাণ হলে কারখানাগুলোর সরবরাহ শৃঙ্খলে গতি আসবে।
বাংলাদেশ হোসিয়ারি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আলহাজ বদিউজ্জামান বদু বলেন, লজিস্টিক ব্যয় কমলে উৎপাদন আরও প্রতিযোগিতামূলক হবে। বন্দর ও মেঘনা শিল্পাঞ্চলের কারখানাগুলো শহরের সঙ্গে দ্রুত সংযোগ পাবে। হোসিয়ারি, ডাইং, বেডশিট, প্যাকেজিং, কেমিক্যাল, প্লাস্টিকসহ অন্তত ১৫০টির বেশি মাঝারি-বড় কারখানার পণ্য পরিবহনে প্রতিদিন কয়েকশ ট্রিপ লাগে। সেতু হলে সময় ৪০-৫০ মিনিট কমবে এবং খরচ ২০-৩০ শতাংশ সাশ্রয় হবে।
বন্দর থেকে শহরে দৈনিক কয়েক হাজার শ্রমিক যাতায়াত করেন। নৌযান, ট্রাফিক ও ঘাটনির্ভরতা তাদের কর্মক্ষেত্রে সময়মতো পৌঁছাতে বড় বাধা। শ্রমবাজার বিশ্লেষকরা মনে করেন, সেতু হলে কর্মঘণ্টার অপচয় কমবে। অনুপস্থিতি ৫৮ শতাংশ হ্রাস পেতে পারে এবং নারীকর্মীদের অংশগ্রহণ বাড়তে পারে। জরুরি সেবা ও অ্যাম্বুলেন্স চলাচলে দ্রুততা আসবে। মাছ ব্যবসায়ী নাসির মিয়া বলেন, ‘ঘণ্টার পর ঘণ্টা নৌকা আর সড়ক জ্যামে আটকে থাকতে হয়। সেতু হলে জীবনটাই বদলে যাবে।’
অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, একনেক অনুমোদিত প্রকল্পের বাস্তব কাজ শুরু হওয়া বিনিয়োগকারীদের কাছে নীতিগত স্থিরতার বার্তা দেয়। নারায়ণগঞ্জ একটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্প শহর হওয়ায় সেতুর মতো অবকাঠামো উন্নয়ন সরাসরি ব্যবসায় প্রভাব ফেলবে।
নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক রায়হান কবির, নাসিক প্রশাসক ড. আবু নছর মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ, এলজিইডির প্রধান নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আহসানুজ্জামানসহ কর্মকর্তারা জানান, সময়ের মধ্যে সেতু নির্মাণ শেষ করতে প্রতিটি ধাপ নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. নূর কুতুবুল আলম, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. আসগর হোসেন, প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী হরিকিংকর মোহন্তসহ সংশ্লিষ্টরা চারারগোপ ঘাটে এসে কাজ পরিদর্শন করেন।
বন্দরবাসীর প্রতিক্রিয়া একই রকম—স্বস্তি আর আনন্দ। বহু বছর ধরে তারা শুনেছেন সেতুর প্রতিশ্রুতি। চারেরগোপের মাছ ব্যবসায়ী নাসির মিয়া বলেন, ‘এই পথ দিয়ে শহরে যেতে কত ভোগান্তি! সেতু হলে আমাদের জীবন বদলে যাবে।’ যুবকরা বলছেন, ‘অনেক বছর শুনছি, এবার চোখে দেখা যাচ্ছে। এটিই বড় কথা।’ প্রবীণ আবদুল খালেক মিয়া যোগ করেন, ‘জীবনে অনেক প্রতিশ্রুতি দেখেছি, কিন্তু কাজ খুব কম। এখন মনে হচ্ছে, বদলের সময় এসেছে।’
শিল্পাঞ্চলের লজিস্টিক খরচ কমবে ২০-৩০ শতাংশ। শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতা বাড়বে। বন্দর-নারায়ণগঞ্জ বাণিজ্যিক নেটওয়ার্ক দ্রুত হবে। বিনিয়োগে নতুন আগ্রহ সৃষ্টি হবে। পরিবহন খাতে বছরে কয়েক কোটি টাকার সময়-খরচ সাশ্রয় হবে। টেস্ট পাইলিং শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শীতলক্ষ্যার পাড়ে যে উৎসাহ দেখা গেছে, তা শুধু উন্নয়ন নয়—এ অঞ্চলের অর্থনীতিকে নতুন গতি দেওয়ার প্রত্যাশাও বহন করে। সেতু নির্মাণের অগ্রগতি ধরে রাখতে পারলে বন্দর-নারায়ণগঞ্জ সংযোগ আগামী কয়েক বছরের মধ্যে দেশের শিল্পবিনিয়োগে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে।

