প্রতিটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সাধারণত বছরের নির্দিষ্ট সময়ে ফাইন্যান্সিয়াল অডিট পরিচালনা করা হয়। এটি করার মুখ্য কারণ হলো ব্যালান্সশিটে কোনো ধরনের তথ্যগত অসংগতি রয়েছে কিনা তা যাচাই করে দেখা।
প্রতিটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সাধারণত বছরের নির্দিষ্ট সময়ে ফাইন্যান্সিয়াল অডিট পরিচালনা করা হয়। এটি করার মুখ্য কারণ হলো ব্যালান্সশিটে কোনো ধরনের তথ্যগত অসংগতি রয়েছে কিনা তা যাচাই করে দেখা। পাশাপাশি অনেক সময় ঘুস লেনদেন বা স্বার্থগত দ্বন্দ্বের কোনো ঘটনা ঘটেছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হয়। সম্পদ অব্যবস্থাপনা, আর্থিক অপরাধ, জালিয়াতি, অবৈধ কর্মকাণ্ড, প্রমাণ সংগ্রহ ইত্যাদি বিষয়াদি এ অডিটের আওতাভুক্ত নয়। এসব বিষয় খতিয়ে দেখতে হলে প্রয়োজন হয় ফরেনসিক অডিটের। দেশের আর্থিক খাতের যে চিত্র বর্তমানে দাঁড়িয়েছে, তাতে ফরেনসিক অডিট পরিচালনা করা একপ্রকার জরুরি হয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে দেশের আর্থিক খাতের মোট সম্পদের আকার ৪২ লাখ কোটি টাকার বেশি। কিন্তু বিগত সময়ে দেশের আর্থিক খাতে নজিরবিহীন অব্যবস্থাপনা ও লুটপাটের প্রেক্ষাপটে একটি প্রশ্ন রয়েই যাচ্ছে—উল্লিখিত সম্পদের মধ্যে কী পরিমাণ বর্তমানে অবশিষ্ট রয়েছে। চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে দেশের ব্যাংক, ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই), বীমা ও পুঁজিবাজার—সব খাতেই খেলাপি ঋণ, অবলোপিত ঋণ, নেগেটিভ ইকুইটি ও অর্থ আত্মসাতের যে চিত্র সামনে এসেছে, তাতে ‘ঘোষিত সম্পদ’ ও ‘প্রকৃত সম্পদ’-এর মধ্যে ব্যাপক ব্যবধান থাকার আশঙ্কাই প্রবল। সেই ব্যবধান জানতে হলে ফরেনসিক অডিটের উদ্যোগ নিতে হবে। আর্থিক খাতের অনিয়ম-দুর্নীতিকারীদের শনাক্ত ও তাদের বিরুদ্ধে তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহের জন্যও এ অডিট পরিচালনা করা দরকার।
দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ দীর্ঘদিন ধরেই রয়েছে। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, দুর্নীতির দায়মুক্তি, নিয়ন্ত্রণের অভাব ও ক্ষমতার অনিয়ন্ত্রিত অপব্যবহারের কারণে এসব প্রতিষ্ঠানে ব্যাপক মাত্রায় অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে, যা আর্থিক খাতকে ভঙ্গুর করে তুলেছে। দেশের অর্থনীতির নাজুক পরিস্থিতির কারণে এগুলোরই দায় রয়েছে। অতীতের এ চর্চা থেকে বের হতে চাইলে অনিয়ম-দুর্নীতির যথাযথ তদন্ত হওয়া দরকার। সেই সঙ্গে অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ কৌশল হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারে ফরেনসিক অডিট। আর ভবিষ্যতে এ অডিটের ধারাবহিকতা বজায় রাখা গেলে তা আর্থিক খাতের দুর্নীতির বিস্তার রোধে সহায়ক হতে পারে।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর এক বছরে ১১টি বেসরকারি ব্যাংক এবং বেসরকারি খাতের বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে তদন্ত ও নিরীক্ষার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। পাশাপাশি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক, ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক খাতের অনিয়ম-দুর্নীতি এবং সম্পদের প্রকৃত পরিস্থিতি জানতে পদক্ষেপ নেয়া হবে বলে অনেকেই প্রত্যাশা করেছিলেন। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। কেবল আর্থিক খাতের প্রতিষ্ঠান নয়, সরকারি যেকোনো প্রতিষ্ঠান, সংস্থা, করপোরেশন ও বিভাগের অনিয়ম-দুর্নীতি নিরীক্ষা করে দেখার কোনো উদ্যোগ নেয়নি সরকার। অথচ সব প্রতিষ্ঠানেরই অনিয়ম-দুর্নীতি উদ্ঘাটনে ফরেনসিক অডিটের পদক্ষেপ জরুরি ছিল। কেননা বিগত সময়ে সরকার, সরকারি কর্তাব্যক্তিরাই সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি করেছেন।
দেশের অগ্রগতির ভিত্তি হলো অর্থনীতি। এটি বিবেচনায় নিয়ে হলেও অন্তত বর্তমানে সরকারের উচিত আর্থিক খাতে ফরেনসিক অডিটের উদ্যোগ নেয়া। দেশের অর্থনীতির হৃৎপিণ্ড হিসেবে ব্যাংক খাতকে বিবেচনা করা হয়। এ খাতে বিতরণ করা ঋণের ৩৫ শতাংশের বেশি বর্তমানে খেলাপি। আদায় অযোগ্য হওয়ায় অবলোপন করা হয়েছে আরো বিপুল অংকের ঋণ। এনবিএফআইগুলোর এক-তৃতীয়াংশের বেশি ঋণ খেলাপি হয়ে পড়েছে, কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এরই মধ্যে অবসায়নের পথে। বীমা কোম্পানিগুলোর ক্ষেত্রে রয়েছে অস্বচ্ছ বিনিয়োগ ও দাবি পরিশোধে ব্যর্থতার অভিযোগ। পুঁজিবাজারসংশ্লিষ্ট বহু প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘদিন ধরে নেগেটিভ ইকুইটির পরিমাণ বেড়ে চলেছে। এমন বাস্তবতায় আর্থিক খাতের ‘গ্রস সম্পদ’ জানার চেয়ে প্রকৃত সম্পদের পরিমাণ জানাটা জরুরি। বাংলাদেশ ব্যাংককে সে উদ্যোগের দিকেও যেতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক যে একীভূত সম্পদের পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে, তা নিঃসন্দেহে একটি ইতিবাচক সূচনা। তবে এটি মূলত আর্থিক প্রতিবেদনের ভিত্তিতে তৈরি করা হয়েছে, যেখানে সম্পদের মান, আদায়যোগ্যতা কিংবা অস্তিত্ব যাচাই করা হয়নি। আন্তর্জাতিকভাবে আর্থিক খাতের স্বাস্থ্য যাচাইয়ের ক্ষেত্রে যেখানে নিট অ্যাসেট, স্ট্রেস টেস্ট ও ফরেনসিক অডিটকে গুরুত্ব দেয়া হয়, সেখানে কেবল গ্রস হিসাব দিয়ে নীতিনির্ধারণ কার্যকর হতে পারে না।
অন্তর্বর্তী সরকার দেশের অর্থনীতির ওপর শ্বেতপত্র প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছিল। কিন্তু কার্যত সেটি খুব বেশি কাজে লাগেনি। সেটিও অনেকটা প্রচলিত অডিটের মতো কাজ করেছে। কিন্তু দীর্ঘ দেড় দশকে আর্থিক খাতের অনিয়ম ও লুণ্ঠনের প্রকৃত পরিমাণ উদ্ঘাটনের জন্য সরকার ফরেনসিক অডিটের ব্যবস্থা করতে পারত। কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংকে ফরেনসিক অডিটের উদ্যোগ বীমা, এনবিএফআই, পুঁজিবাজারসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান এবং রাষ্ট্রায়ত্ত তহবিল ও বিশেষায়িত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও বর্ধিত করা প্রয়োজন। এসব খাত জনস্বার্থের সঙ্গে সরাসরি জড়িত।
জনগণের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের অন্যতম অগ্রাধিকারের জায়গা হওয়া প্রয়োজন। এটি মনে রাখা প্রয়োজন যে জনগণের আমানতই আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আয়ের প্রধানতম উৎস। গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে ব্যাংকের আমানত কমতে দেখা গেছে। পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ মন্দা দেখা গেছে। এর প্রধান কারণ এসব খাতের প্রতি তৈরি হওয়া অনাস্থা। সত্য হলো, এ পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন এখনো ঘটেনি। এর কারণ দেশের আর্থিক খাতের প্রতি জনগণের আস্থা সংকট রয়েই গেছে। জনগণ এখনো দ্বিধান্বিত।
ফরেনসিক অডিটের মাধ্যমে প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরা গেলে অন্তত জনগণের দ্বিধা দূর করা যেত, যা আস্থা পুনরুদ্ধারে ভূমিকা রাখত। সেই সঙ্গে বিদ্যমান পরিস্থিতি থেকে আর্থিক খাতের উন্নয়নেও কার্যকর নীতি নেয়া সম্ভব হতো। প্রকৃত আর্থিক অবস্থান না জেনে অর্থনৈতিক সংস্কার বা পুনরুদ্ধার কখনই সম্ভব নয়। সরকারের অর্থনৈতিক সংস্কার ঘিরে যে প্রতিশ্রুতি তা পূরণেও জরুরি হলো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সম্পদের গুণগত মান প্রকাশের ব্যবস্থা করা। এটি আর্থিক খাতের স্বচ্ছতা ও টেকসই সংস্কারের পূর্বশর্তও। সূত্র: বণিক বার্তা

