অর্থের টানাপোড়েনে থাকা অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার শুরু থেকেই ব্যয় সাশ্রয়ের নীতি গ্রহণ করে। সেই নীতির আলোকে অনেক মন্ত্রণালয়ই তাদের পরিচালন ব্যয় কমিয়েছে। তবে এর ব্যতিক্রম চিত্র দেখা যাচ্ছে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে। উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী দায়িত্ব নেওয়ার পর এ মন্ত্রণালয়ের পরিচালন ব্যয় বরং বেড়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২৪–২৫ অর্থবছরে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পরিচালন ব্যয় অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি। ওই অর্থবছরে মন্ত্রণালয়টির পরিচালন ব্যয় দাঁড়ায় ৪১০ কোটি টাকা। এর আগের ২০২৩–২৪ অর্থবছরে এ খাতে ব্যয় ছিল ৩৯৩ কোটি টাকা। ২০২২–২৩ অর্থবছরে পরিচালন ব্যয় ছিল ৩৩৭ কোটি টাকা।
চলতি ২০২৫–২৬ অর্থবছরে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মোট পরিচালন ও উন্নয়ন ব্যয় ধরা হয়েছে ৮২৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে পরিচালন ব্যয়ের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৪৮৭ কোটি টাকা। বাকি ৩৩৭ কোটি টাকা উন্নয়ন ব্যয় হিসেবে নির্ধারিত। অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিক, অর্থাৎ জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে মন্ত্রণালয়টির মোট ব্যয় হয়েছে ১০৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে সাড়ে ৯০ কোটি টাকা খরচ হয়েছে পরিচালন খাতে। সরকার যখন ব্যয় সংকোচনের নীতিতে চলছে, তখন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ক্রমবর্ধমান পরিচালন ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। ব্যয় সাশ্রয়ের ঘোষিত নীতির সঙ্গে বাস্তব চিত্রের এই বৈপরীত্য নীতিনির্ধারকদের নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে।
গত বছরের ১০ নভেম্বর অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেন চলচ্চিত্র নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। শপথের পর তাকে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। সে হিসাবে উপদেষ্টা পদে তিনি এক বছরের বেশি সময় ধরে দায়িত্ব পালন করছেন।
সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, দায়িত্ব নেওয়ার পর মোস্তফা সরয়ার ফারুকী সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে ব্যতিক্রমী কিছু উদ্যোগ নেন। বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে মন্ত্রণালয়টিকে সক্রিয় করার চেষ্টা করা হয়। তবে এসব উদ্যোগের মধ্যেও পরিচালন ব্যয় বৃদ্ধিকে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়নি।
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অর্থ ব্যয়ের ন্যায্যতা নিয়ে নানা সময়ে প্রশ্ন উঠেছিল। সরকারদলীয় প্রচারণামূলক কর্মসূচির নামে অর্থ অপচয় ও লোপাটের অভিযোগও ছিল। অন্তর্বর্তী সরকারের সময়েও এই মন্ত্রণালয়ের ব্যয় না কমাকে অনেকে হতাশাজনক বলে মনে করছেন।
এ বিষয়ে উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বলেন, “সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় ছিল প্রায় মৃতপ্রায়। অতীতে এই মন্ত্রণালয়ের নামই শোনা যেত না। দায়িত্ব নেওয়ার পর আমি মন্ত্রণালয়টিকে জাগিয়ে তুলেছি। তাই ব্যয় কিছুটা বাড়া স্বাভাবিক।”
তিনি আরও বলেন, “গত এক বছরে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় থেকে এমন অনেক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যা আগে কখনো দেখা যায়নি। নববর্ষ উদযাপন, ঈদ, পূজা, বুদ্ধপূর্ণিমাসহ সব জাতি, ধর্ম ও বর্ণের মানুষের জন্য নানা আয়োজন করা হয়েছে। চব্বিশের জুলাই গণ-অভ্যুত্থান স্মরণে বিভিন্ন কর্মসূচিও পালিত হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ প্রতিটি টাকা স্বচ্ছতার সঙ্গে ব্যয় করা হয়েছে। কারও কোনো প্রশ্ন থাকলে মন্ত্রণালয়ে এসে তা যাচাই করতে পারবেন।”
সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় পরিচালন ব্যয় কমাতে না পারলেও অন্তর্বর্তী সরকারের কয়েকটি মন্ত্রণালয় এ ক্ষেত্রে সাফল্য দেখিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর সঙ্গে একই দিনে উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান শেখ বশিরউদ্দীন।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩–২৪ অর্থবছরে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পরিচালন ব্যয় ছিল ২২০ কোটি টাকা। ২০২৪–২৫ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়ায় ১৮৩ কোটি টাকায়। যদিও ওই অর্থবছরে পরিচালন ব্যয়ের জন্য বরাদ্দ ছিল ৩০১ কোটি টাকা। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি পরিচালন ব্যয় কমাতে পেরেছে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ও। এ মন্ত্রণালয়সহ একাধিক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে রয়েছেন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। ২০২৩–২৪ অর্থবছরে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের পরিচালন ব্যয় ছিল ৭১১ কোটি টাকা। ২০২৪–২৫ অর্থবছরে তা কমে ৬৭৬ কোটি টাকায় নেমে আসে। যদিও বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৭২৮ কোটি টাকা।
উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর মোস্তফা সরয়ার ফারুকী কী কী উদ্যোগ ও কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছেন, তার একটি বিস্তৃত তালিকা পাঠিয়েছে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়। তালিকায় বলা হয়েছে, চব্বিশের জুলাই গণ-অভ্যুত্থান স্মরণে রেখে সব ধর্ম ও জাতির অংশগ্রহণে নববর্ষ উদযাপন আয়োজন করা হয়েছে। পাশাপাশি জাতীয় পর্যায়ে উদ্যাপিত হয়েছে ঈদ, বুদ্ধপূর্ণিমা ও দুর্গা পূজা।
প্রথমবারের মতো রাষ্ট্রীয়ভাবে পালিত হয়েছে ফকির লালন শাহের তিরোধান দিবস। দেশজুড়ে বেসরকারি সংগীত স্কুলগুলোকে দেওয়া হয়েছে অর্থনৈতিক প্রণোদনা। শিল্পকলা একাডেমিতে সংগীত বিভাগের আধুনিকায়ন এবং অনলাইন কার্যক্রম সম্প্রসারণের উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া ‘নদীপথে সুরভ্রমণ’ শীর্ষক অডিও–ভিজ্যুয়াল প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থান ও ফ্যাসিবাদী শাসন নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ হয়েছে। প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে জুলাই স্মৃতি জাদুঘর। আয়োজন করা হয়েছে জুলাই পুনর্জাগরণ অনুষ্ঠানমালা। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশকে তুলে ধরতে চালু করা হয়েছে আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ‘বাংলাদেশ জুলাই মেমোরিয়াল প্রাইজ’। ইউনেস্কো ও চীনে সাংস্কৃতিক আয়োজন এবং আন্তর্জাতিক প্রশিক্ষণ কার্যক্রমও বাস্তবায়ন করা হয়েছে।
মন্ত্রণালয়ের তালিকায় আরও উল্লেখ করা হয়, দেশের প্রত্নতাত্ত্বিক সাইটে সাংস্কৃতিক উৎসব আয়োজন করা হয়েছে। কিংবদন্তি শিল্পীদের স্মরণ এবং ইতিহাসের নির্মোহ উপস্থাপনার মাধ্যমে দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বিশ্বমঞ্চে তুলে ধরার লক্ষ্যেও কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে।
তবে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের এই বিস্তৃত কর্মকাণ্ডের তালিকার সঙ্গে একমত নন চলচ্চিত্র গবেষক ও সমালোচক বিধান রিবেরু। তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর দেশে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বাস্তবে কমেছে। তার মতে, মন্ত্রণালয়ের ব্যয় বাড়লেও সাংস্কৃতিক অঙ্গন কতটা লাভবান হচ্ছে বা সাধারণ মানুষ কোনো সুফল পাচ্ছে কিনা, সেটিই বড় প্রশ্ন।
তিনি বলেন, গত এক বছরে জোরপূর্বক অনেক গানের অনুষ্ঠান বন্ধ করা হয়েছে। নিরাপত্তা শঙ্কায় কিছু কনসার্ট অনুষ্ঠিতই হয়নি। সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ বাউল শিল্পীদের ওপর হামলার ঘটনাও ঘটেছে। মামলা ও গ্রেফতারের ঘটনাও দেখা গেছে। এসব বিষয়ে সরকারের কোনো পক্ষ থেকেই জোরালো ভূমিকা চোখে পড়েনি। তার ভাষায়, সংস্কৃতি যেন এখন একটি ব্রাত্য বিষয়।
বিধান রিবেরু আরও বলেন, ঘটনার পেছনের কারণগুলো সবার জানা। এসব কারণ যেমন সাধারণ মানুষকে কষ্ট দেয়, তেমনি দায়িত্বপ্রাপ্ত মানুষদের নিশ্চুপ ভূমিকা আরও হতাশাজনক। তিনি বলেন, বাংলাদেশ একটি গরিব দেশ। তাই প্রতিটি খরচ হওয়া উচিত হিসাব করে। দুর্নীতিতে নিমজ্জিত এই বাস্তবতা থেকে উত্তরণের একটি পথ হতে পারে সাংস্কৃতিক বিপ্লব। অথচ সেই সংস্কৃতিই এখন সবচেয়ে বেশি উপেক্ষিত। তিনি একে দেশের জন্য দুর্ভাগ্যজনক বলে মন্তব্য করেন।
সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম নিয়ে ভিন্নমত উঠে এসেছে সাংস্কৃতিক অঙ্গনের বিভিন্নজনের কাছ থেকেও। অভিনেতা তারিক আনাম খানের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তার দৃষ্টিতে আগের সময়ের তুলনায় সাংস্কৃতিক অঙ্গনে এখনো তেমন কোনো দৃশ্যমান পরিবর্তন চোখে পড়েনি। তবে মন্ত্রণালয়ের পরিচালন ব্যয় বৃদ্ধি নিয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করতে চাননি।
অন্যদিকে বিশিষ্ট চলচ্চিত্র নির্মাতা অমিতাভ রেজা চৌধুরী সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডকে তুলনামূলক ইতিবাচক হিসেবেই দেখছেন। তিনি বলেন, গত এক বছরে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে কিছু ভালো কাজ হয়েছে, যা চোখে পড়েছে। বিশেষ করে কিছু ডকুমেন্টারি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে এবং এ ধরনের কাজ এখন নিয়মিতভাবে হচ্ছে। তবে এসব উদ্যোগের প্রকৃত প্রভাব কতটা পড়বে, তা সময়ের সঙ্গে বোঝা যাবে। এখনই নিশ্চিত করে কিছু বলা কঠিন বলেও মন্তব্য করেন তিনি। একই সঙ্গে তিনি বলেন, যেকোনো সৃজনশীল কাজ বাস্তবায়নে বাজেটের প্রয়োজন হয়।
প্রসঙ্গত, গত দেড় দশকে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার সরকার বাছবিচার ছাড়াই জাতীয় বাজেটের আকার বাড়িয়েছে এবং একের পর এক উন্নয়ন প্রকল্প নিয়েছে। ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার সময় দেশের ওপর প্রায় ১৯ লাখ কোটি টাকার ঋণের বোঝা রেখে যায় সেই সরকার। এ ঋণ নেওয়া হয়েছে দেশী ও বিদেশী উভয় উৎস থেকে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতা গ্রহণের সময় সরকারের ঋণ স্থিতি ছিল ২ লাখ ৭৬ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা। পরবর্তী দেড় দশকে এই ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৬ লাখ কোটি টাকা, যা সরকারের মোট ঋণের প্রায় ৮৫ শতাংশ। অর্থ মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যানেই উঠে এসেছে সরকারের ঋণ বৃদ্ধির এই অস্বাভাবিক চিত্র।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ঘোষিত বাজেটগুলোতে পরিচালন ব্যয় ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের কথা বলে দেশী-বিদেশী উৎস থেকে বিপুল ঋণ নেওয়া হয়। তবে একই সময়ে সরকারের বিরুদ্ধে সীমাহীন অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগও উঠেছে। বিশেষ করে ব্যাংক খাত এই সময়ে ব্যাপক লুণ্ঠনের শিকার হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর গত দেড় বছরে সরকারের ঋণের বোঝা আরও বেড়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, চলতি বছরের জুন শেষে সরকারের মোট ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ২১ লাখ ৪৪ হাজার ৩৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১১ লাখ ৯৪ হাজার ৮৫৩ কোটি টাকা এসেছে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে, যার মধ্যে রয়েছে ব্যাংক, সঞ্চয়পত্রসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। বাকি ৯ লাখ ৪৯ হাজার ১৮১ কোটি টাকা নেওয়া হয়েছে বিদেশী উৎস থেকে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন শেষে সরকার ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিদেশী ঋণের স্থিতি ছিল ৯৩ দশমিক ৪২ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশী মুদ্রায় এর পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ১১ লাখ ৩৯ হাজার কোটি টাকা।

