নিবিড় নজরদারিতে থাকার পরও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে দেশ ছাড়ল ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদি হত্যাচেষ্টায় জড়িত দুই প্রধান সন্দেহভাজন।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ফয়সাল করিম মাসুদ ওরফে দাউদ খান এবং আলমগীর হোসেন দেশ ছাড়ার তথ্য নিশ্চিত। যদিও পুলিশের পক্ষ থেকে গতকাল রাত ১০টায় এ তথ্য আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করা হয়নি। প্রসঙ্গত, এই দুই আততায়ীকে ধরার জন্য অর্ধকোটি টাকার পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছিল। সীমান্তে সতর্কতা জারি করা হয়েছিল এবং পাসপোর্টও ব্লক করা হয়েছিল। তবুও তারা ময়মনসিংহের সীমান্তঘেঁষা হালুয়াঘাট উপজেলার একটি দুর্গম সীমান্ত পথ পাড়ি দিয়ে ভারতের মেঘালয়ে পালিয়ে যায়। তাদের সঙ্গে সীমান্ত পারাপারে সহায়তা করার অভিযোগে দুই মানব পাচারকারীও আটক হয়েছে।
এর আগে গত শুক্রবার দুপুরে রাজধানীর পল্টনের বক্স কালভার্ট রোডে মোটরসাইকেলে আসা দুই আততায়ী শরিফ ওসমান হাদিকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়। ঘটনা ঘটে এমন সময়ে হাদি রিকশায় ছিলেন। পুলিশ পরদিন ফয়সালের ছবি প্রকাশ করে পুরস্কার ঘোষণা করে। জানা যায়, ফয়সাল গুলি চালিয়েছে, আর আলমগীর মোটরসাইকেল চালাচ্ছিল। রোববার পুলিশ সেই মোটরসাইকেল উদ্ধার করেছে।
হাদি আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী। সংকটাপন্ন অবস্থায় তিনি রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। আজ সোমবার দুপুরে তাকে সিঙ্গাপুরের একটি হাসপাতালে পাঠানোর জন্য এয়ার অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থাও করা হয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং জানিয়েছে, প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নির্দেশে সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, প্রধান উপদেষ্টার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়বিষয়ক বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. সায়েদুর রহমান, এভারকেয়ার হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডা. জাফর এবং ওসমান হাদির ভাই ওমর বিন হাদির মধ্যে একটি জরুরি টেলিফোন কনফারেন্সে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, শরিফ ওসমান হাদির উপর হামলার পরই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মূল সন্দেহভাজন হিসেবে ফয়সাল করিম মাসুদ ও আলমগীর হোসেনকে শনাক্ত করে। প্রযুক্তির মাধ্যমে তাদের গতিবিধি অনুসরণ করা হলেও তারা ডিজিটাল ডিভাইস নিজেরা বহন করেনি।
তদন্ত সূত্র জানায়, তারা তাদের মোবাইল ফোনসহ অন্যান্য প্রযুক্তি সামগ্রী সচল রেখেও ডিভাইসগুলোকে বারবার ভিন্ন স্থানে সরানো হয়। পুলিশ যখন ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ডিভাইসের অবস্থান ধরে অভিযান চালাচ্ছিল, তখন তারা রাজধানী ছেড়ে নিরাপদে ময়মনসিংহ হয়ে হালুয়াঘাট পৌঁছায় বলে ধারণা করা হচ্ছে।
হাদিকে গুলি করার পরই তারা পল্টনের কালভার্ট রোড থেকে মোটরসাইকেল নিয়ে নয়াপল্টন, শাহবাগ, বাংলামটর, কারওয়ান বাজার, ফার্মগেট হয়ে আগারগাঁও এলাকা দিয়ে মিরপুরে পৌঁছায়।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও ময়মনসিংহ সীমান্তের স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে, ফয়সাল ও আলমগীর প্রাইভেটকারে আশুলিয়া হয়ে গাজীপুর পার হয়ে সড়কপথে ময়মনসিংহ পৌঁছায়। ব্রিজের পাড়ে বাহন পরিবর্তন করে হালুয়াঘাটের উদ্দেশে আরেকটি প্রাইভেটকারে যাত্রা করে। পেট্রোল পাম্পে থামার পর তিনজন যুবক তাদের মোটরসাইকেলে তুলে ভুটিয়াপাড়ায় নিয়ে যায়। রাত আড়াইটা পর্যন্ত সীমান্ত পাড়ি দিয়ে তারা ভারতের মেঘালয় রাজ্যের পশ্চিম গারো পাহাড় জেলার তুরা পৌরসভা এলাকায় পৌঁছায়। গতকাল পর্যন্ত তারা সেখানেই অবস্থান করছে বলে জানা গেছে।
হাদিকে হত্যাচেষ্টায় জড়িতদের বিষয়ে তথ্য জানাতে গতকাল সংবাদ সম্মেলনে আসেন ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার এস এন নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, “অভিযুক্তদের কেউ বিদেশে পালিয়ে গেছে কি না—এমন কোনো তথ্য এখনও ইমিগ্রেশন ডাটাবেজে পাওয়া যায়নি। ফয়সাল করিম মাসুদের সর্বশেষ বিদেশ যাত্রার তথ্য অনুযায়ী, তিনি গত জুলাইয়ে থাইল্যান্ড থেকে দেশে প্রবেশ করেন। এরপর তার কোনো দেশত্যাগের রেকর্ড নেই।”
পুলিশ জানিয়েছে, শেরপুরের নালিতাবাড়ী থেকে সীমান্ত পারাপারে জড়িত দুই সদস্যকে আটক করা হয়েছে। এদের সঙ্গে হাদির ওপর হামলায় ব্যবহৃত মোটরসাইকেলটির মালিক আব্দুল হান্নানকেও র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন-২ গ্রেপ্তার করে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছে। ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার এস এন নজরুল ইসলাম বলেন, “যারা এই ঘটনায় জড়িত, তাদের সবাইকে শনাক্ত করে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।”
পুলিশ সূত্র জানায়, হালুয়াঘাট সীমান্ত থেকে আটককৃতরা হলো সিবিয়ন দিও ও সঞ্চয় চিসিম। গত শনিবার ময়মনসিংহের সীমান্ত উপজেলা হালুয়াঘাট, ফুলপুর, ধোবাউড়া এবং নিকটবর্তী শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ীতে অভিযান চালানো হয়। ওই অভিযানে আটক দুই জন ফয়সাল ও আলমগীরকে সীমান্ত পার করানোর অভিযোগে জড়িত ছিল। পুলিশ জানিয়েছে, আটকের পর তাদের মাধ্যমে পালানো আততায়ীদের ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হয়েছিল, কিন্তু তা সফল হয়নি।
এদিকে হাদির ওপর হামলায় মূল সন্দেহভাজন ফয়সাল করিম মাসুদের সব ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। তার আইটি প্রতিষ্ঠান অ্যাপল সফট আইটি লিমিটেডের ব্যাংক হিসাবও জব্দ করা হয়েছে। এনবিআরের সূত্র জানিয়েছে, ব্যাংক হিসাব জব্দের চিঠি গতকাল সব ব্যাংকে পাঠানো হয়েছে।
হাদিকে হত্যাচেষ্টায় জড়িতদের সঙ্গে মোবাইল ফোনের যোগাযোগ বিশ্লেষণ করে ডিএমপির গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি) মো. মিলন ও হাবিবুর রহমান হাবিব নামে দুজনকে আটক করেছে। রাজধানীর হেমায়েতপুরের জাদুর চর থেকে আটক এই দুই জন মোটরসাইকেল চালানো আলমগীরের ঘনিষ্ঠ সহযোগী। ঘটনার দিনে তারা একশবারের বেশি মোবাইলে যোগাযোগ করেছে। তদন্ত সূত্রে জানা গেছে, আলমগীরের মোবাইল ফোন থেকে মিলনের সঙ্গে ৭৪ বার যোগাযোগ হয়েছে। হাবিবের ফোনে আলমগীরের সঙ্গে ৫২ বার যোগাযোগের তথ্য মিলেছে।
এ ছাড়াও ফয়সাল করিম মাসুদের স্ত্রী, শ্যালক ও এক বান্ধবীকে র্যাব আটক করেছে। গতকাল ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ থেকে তাদের আটক করা হয়। তারা হলো ফয়সালের স্ত্রী সামিয়া, শ্যালক শিপু ও বান্ধবী মারিয়া। র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক উইং কমান্ডার এম জেড এম ইন্তেখাব চৌধুরী বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
হাদিকে হত্যাচেষ্টায় ব্যবহৃত মোটরসাইকেলের মালিক মো. আব্দুল হান্নানকে গত শনিবার ভোরে রাজধানীর আদাবরের সুনিবির হাউজিংয়ের ভাড়া বাসা থেকে র্যাব-২ গ্রেপ্তার করে। পরে তাকে পল্টন থানা পুলিশের হাতে হস্তান্তর করা হয়। থানা পুলিশ তাকে সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে তোলে। ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট দিদারুল আলম সন্ধ্যায় তার তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
হান্নানের স্ত্রী পারভীন পল্টন থানায় বলেন, “আমার স্বামী একজন ঠিকাদার। ওই বাইকটি কয়েক মাস আগে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছিল। তিনি সেটি ব্যবহার করতেন না। আমার স্বামী নির্দোষ।” ঢাকা মহানগর পুলিশের পাবলিক রিলেশনস কর্মকর্তা মুহাম্মদ তালেবুর রহমান জানিয়েছেন, হাদি হত্যাচেষ্টায় ব্যবহৃত মোটরসাইকেলটি উদ্ধার করা হয়েছে।
একই দিনে ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মাকে তলব করে হাদির ওপর হামলাকারীদের গ্রেপ্তারের জন্য বাংলাদেশ অনুরোধ জানিয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অব্যাহত উসকানিমূলক বক্তব্যের প্রেক্ষিতে অন্তর্বর্তী সরকার উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এছাড়া হাদিকে গুলি করা সন্দেহভাজনরা ভারতে পালিয়েছে বলে গুঞ্জন থাকায়, তাদের দেশে ফেরানোর জন্য ভারতের সহযোগিতাও চাওয়া হয়েছে।
ওসমান হাদিকে উন্নত চিকিৎসার জন্য আজ এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে সিঙ্গাপুরে নেওয়া হবে। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং জানিয়েছে, দুই দিন ধরে তার চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার কয়েকটি হাসপাতালে যোগাযোগ করা হয়েছে। এভারকেয়ার হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দলের পরামর্শ ও পরিবারের সঙ্গে আলোচনার পর প্রধান উপদেষ্টাকে বিষয়টি অবহিত করা হয়। প্রধান উপদেষ্টার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়বিষয়ক বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. সায়েদুর রহমান জানিয়েছেন, হাদির শারীরিক অবস্থা অপরিবর্তিত।
প্রেস উইং জানিয়েছে, সিঙ্গাপুরে হাদির চিকিৎসার সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। প্রয়োজনীয় মেডিকেল এয়ার অ্যাম্বুলেন্স, চিকিৎসক দল ও ভ্রমণসংক্রান্ত সব ব্যবস্থা সম্পন্ন। সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালের অ্যাক্সিডেন্ট ইমার্জেন্সি বিভাগে তার চিকিৎসার সব আয়োজন করা হয়েছে। চিকিৎসার সব ব্যয় রাষ্ট্রীয়ভাবে বহন করা হবে। প্রধান উপদেষ্টা সব পর্যবেক্ষণ সরাসরি নজরদারিতে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। দ্রুত সুস্থতার জন্য দেশবাসীর কাছে দোয়া ও প্রার্থনা চাওয়া হয়েছে।
ওসমান হাদিকে গুলির ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তারে ব্যর্থতার অভিযোগ তুলে সরকারের কঠোর সমালোচনা করেছে ইনকিলাব মঞ্চ। এ ঘটনায় আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল এবং স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর পদত্যাগ দাবি করেছে সংগঠনটি।
এর প্রতিবাদে আজ সোমবার বেলা তিনটায় রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সর্বদলীয় প্রতিরোধ সমাবেশের ঘোষণা দিয়েছে ইনকিলাব মঞ্চ। গতকাল রাতে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালের সামনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ কর্মসূচি ঘোষণা করেন সংগঠনের সদস্যসচিব আব্দুল্লাহ আল জাবের।
সংবাদ সম্মেলনে হাদির শারীরিক অবস্থার কথা তুলে ধরে আব্দুল্লাহ আল জাবের বলেন, তার অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। ইনকিলাব মঞ্চ ও হাদির পরিবার তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। চিকিৎসকদের সম্মতি পেলেই তাকে বিদেশে পাঠানো হবে। তিনি জানান, এ জন্য অর্ধকোটি টাকা ব্যয়ে একটি এয়ার অ্যাম্বুল্যান্স ইতোমধ্যে ভাড়া করা হয়েছে।
সরকারকে হুঁশিয়ার করে তিনি বলেন, হাদির কোনো ক্ষতি হলে এর দায় সরকারকেই নিতে হবে। তার ভাষায়, হাদির যদি খারাপ কিছু হয়, তাহলে এই অন্তর্বর্তী সরকারের বিদায় ঘণ্টা তখনই বেজে উঠবে। কারণ ছাত্র-জনতাই এই সরকারকে ক্ষমতায় বসিয়েছে এবং তারাই প্রয়োজনে নামিয়ে দেবে।

