চার বছর ধরে টানা ধসের পর অবশেষে ঘুরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত দিচ্ছে বাংলাদেশের পাটপণ্য রপ্তানি। একসময়ের ‘সোনালি আঁশ’ হিসেবে পরিচিত পাটের পণ্যের প্রতি আবারও আগ্রহ বাড়তে শুরু করেছে আন্তর্জাতিক বাজারে। বিশেষ করে তুরস্কসহ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দেশে চাহিদা বাড়ায় মিল মালিক ও রপ্তানিকারকদের মধ্যে নতুন করে আশার সঞ্চার হয়েছে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে পাটপণ্য রপ্তানি আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১.৩৬ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৪৬ মিলিয়ন ডলারে। দীর্ঘ সময়ের পতনের ধারার পর এই প্রবৃদ্ধিকে খাতসংশ্লিষ্টরা ইতিবাচক মোড় হিসেবে দেখছেন।
রপ্তানিকারকদের মতে, তুরস্কে পাটের সুতা বা জুট ইয়ার্নের চাহিদা বাড়া এই পুনরুদ্ধারের অন্যতম প্রধান কারণ। পাশাপাশি বড় অর্থনীতিগুলোতে সুদের হার কমার সম্ভাবনা, মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা কিছুটা কমে আসা এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ অবসানের আলোচনা বিশ্ব অর্থনীতিতে যে স্বস্তির আভাস দিচ্ছে, তাও বাজারে আস্থার পরিবেশ তৈরি করেছে।
গত অর্থবছর ২০২৪-২৫ সালে পাটপণ্যের রপ্তানি মোটের ওপর ৪ শতাংশ কমে গিয়েছিল। অথচ তার আগে ২০২০-২১ অর্থবছরে এই খাত থেকেই এসেছিল ১.১৬ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি আয়। সেই উচ্চতা থেকে টানা পতনের পর চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই, বিশেষ করে জুলাই মাস থেকে, ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়ানোর লক্ষণ দেখা যাচ্ছে।
বাংলাদেশ জুট স্পিনার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজেএসএ) চেয়ারম্যান তাপস প্রামাণিক বলেন, তুরস্কসহ কয়েকটি দেশ থেকে নতুন অর্ডার বাড়তে শুরু করেছে। এতে করে পাটশিল্পে আবারও প্রাণ ফেরার আশা তৈরি হয়েছে। তাঁর ভাষায়, দীর্ঘদিন ধরে পাটের পণ্য বিক্রি করতে না পেরে মিল মালিকদের মধ্যে চরম হতাশা কাজ করছিল। এখন হেসিয়ান, স্যাকিং ও সুতা—সব ক্ষেত্রেই বিক্রির উন্নতি দেখা যাচ্ছে।
শিল্পসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ২০২১ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে পাটখাত রপ্তানির প্রায় ২৯ শতাংশ হারিয়েছে। মূলত দেশে কাঁচা পাটের দাম বেড়ে যাওয়ায় অনেক বিদেশি ক্রেতা সিনথেটিক বা রিজেনারেটেড কটন ইয়ার্নের দিকে ঝুঁকে পড়েছিলেন। করোনা মহামারির পর ২০২১ সালে কাঁচা পাটের দাম হঠাৎ বেড়ে মণপ্রতি ৫ হাজার ৫০০ থেকে ৬ হাজার টাকায় পৌঁছায়, যা চাহিদা কমে যাওয়ার বড় কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
চলতি বছরে পরিস্থিতি কিছুটা বদলেছে। বর্তমানে কাঁচা পাটের দাম মণপ্রতি প্রায় ৪ হাজার ২০০ থেকে ৪ হাজার ৩০০ টাকায় স্থিতিশীল রয়েছে। উৎপাদন কমে যাওয়ায় দাম বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কায় সরকার গত সেপ্টেম্বরে কাঁচা পাট রপ্তানিতে বিধিনিষেধ আরোপ করে, যা দেশীয় বাজারে স্থিতিশীলতা আনতে সহায়ক হয়েছে।
আকিজ বশির গ্রুপের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর হেলাল আহমেদ বলেন, কাঁচা পাট রপ্তানি নিয়ন্ত্রণে থাকায় স্থিতিশীল দামে পাটপণ্য রপ্তানি সম্ভব হচ্ছে। একই সঙ্গে ভারতে কাঁচা পাটের দাম বেশি থাকায় সেখান থেকে রপ্তানি কমেছে, যা বাংলাদেশের জন্য সুযোগ তৈরি করেছে। তিনি আরও জানান, যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ভারতের পণ্যে ৫০ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপের ফলে মার্কিন বাজারে বাংলাদেশি পাটপণ্যের চাহিদা বেড়েছে এবং বিভিন্ন ধরনের ফ্যাব্রিকের চালান সেখানে বাড়ছে।
বর্তমানে তুরস্ক পাটের কার্পেট সুতা ও রোপ-টুইনের অন্যতম বড় ক্রেতা। এ ছাড়া নেদারল্যান্ডস, ইতালি, চীন, ভারত, উজবেকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, তানজানিয়া, সুদান এবং মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশেও পাটপণ্যের ভালো চাহিদা রয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাজ্যের বাজারে আলুর বস্তা, হেসিয়ান ব্যাগ, লিনোলিয়াম কাপড়, নার্সারি কাপড় এবং সাজসজ্জা ও বাগানের কাজে ব্যবহৃত ছোট স্পুল ও বল আকারের বৈচিত্র্যময় সুতা ও টুইনের চাহিদা বাড়ছে।
এই ইতিবাচক ধারা অব্যাহত থাকবে বলে আশা করছেন রপ্তানিকারকরা। বিজেএসএ চেয়ারম্যান তাপস প্রামাণিক জানান, গত বছর মাসে গড়ে প্রায় ৪০ হাজার টন পাটপণ্য রপ্তানি হয়েছে, চলতি বছরে এই পরিমাণ আরও বাড়তে পারে।
তবে খাতটির টেকসই পুনরুদ্ধারের জন্য সরকারি সহায়তা জরুরি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশ জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিজেএমএ) মহাসচিব আবদুল বারিক খান বলেন, নতুন বাজারে প্রবেশ সহজ করতে নীতিগত সহায়তা দরকার। স্বল্প সুদের ঋণ এবং প্রণোদনা পেলে রপ্তানি আরও বাড়ানো সম্ভব।
তাপস প্রামাণিকও একই সুরে বলেন, বর্তমানে ঋণের সুদের হার ১৫.৫ শতাংশ পর্যন্ত, যা ব্যবসা পরিচালনাকে অত্যন্ত কঠিন করে তুলেছে। তাঁর মতে, সরকারের সঙ্গে নিয়মিত আলোচনা ও কার্যকর নীতিগত সহায়তা পেলে পাটখাত আবারও শক্ত অবস্থানে ফিরতে পারে এবং দেশের রপ্তানিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম হবে।

