চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই সরকারের উন্নয়ন ব্যয় আশঙ্কাজনকভাবে ধীর হয়ে পড়েছে। মাঠপর্যায়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন প্রত্যাশার তুলনায় অনেক পিছিয়ে। সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর সমন্বয় ঘাটতি, প্রশাসনিক টানাপোড়েন এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার প্রভাবও স্পষ্ট।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) যে হালনাগাদ প্রতিবেদনে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে সরকারি বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বড় হলেও বাস্তব অগ্রগতি খুবই হতাশাজনক।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত পাঁচ মাসে উন্নয়ন ব্যয় হয়েছে ২৮ হাজার ৪৩ কোটি টাকা। এটি বরাদ্দের মাত্র ১১.৭৫ শতাংশ। তুলনায় আগের অর্থবছরের একই সময়ে ব্যয় ছিল ৩৪ হাজার ২১৫ কোটি টাকা বা ১২.২৯ শতাংশ। অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় পিছিয়ে আছে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা। এটি স্পষ্ট করছে, সরকারের উন্নয়ন প্রকল্প যথাযথভাবে এগোচ্ছে না। সরকারি তহবিল, বৈদেশিক সহায়তা এবং সংস্থাগুলোর নিজস্ব অর্থায়নে প্রকল্প বাস্তবায়নে মন্থরতা লক্ষণীয়।
শুধু অর্থবছরের সার্বিক অবস্থাই নয়, এডিপির মাসওয়ারি অগ্রগতি পর্যালোচনায় দেখা গেছে নভেম্বর মাসের তথ্য আরও উদ্বেগজনক। ওই মাসে বাস্তবায়ন হয়েছে ৮ হাজার ১৬৫ কোটি টাকার। তুলনায় আগের বছরের নভেম্বর মাসে ব্যয় ছিল ১২ হাজার কোটি টাকার বেশি। এক মাসে প্রকল্প ব্যয় কমেছে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের হার মাত্র ৩.৪২ শতাংশ। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, এই ধীরগতি কোনো স্বাভাবিক মৌসুমি প্রবণতা নয়। বরং এটি প্রকল্প ব্যবস্থাপনায় জমে থাকা নানা অচলাবস্থার ফল।
প্রকল্প অনুমোদনে বিলম্ব, টেন্ডার প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হওয়া, দক্ষ ঠিকাদারের অভাব এবং মাঠপর্যায়ে প্রকৌশল বিভাগগুলোর সংকোচন—এসব কারণে উন্নয়ন ব্যয় আটকে আছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সরকার পরিবর্তনের পর প্রশাসনে ধীরগতি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে দ্বিধা। আইএমইডি কর্মকর্তারা বলছেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময়ে পুরো প্রশাসনিক কাঠামো একধরনের অচল অবস্থায় ছিল, যার প্রভাব এখনও কাটেনি।
মন্ত্রণালয়ভিত্তিক ব্যয়ের বৈষম্যও স্পষ্ট। বরাদ্দ থাকা সত্ত্বেও সংসদবিষয়ক সচিবালয় পাঁচ মাসে একটাকাও ব্যয় করতে পারেনি। কিছু বিভাগ অগ্রগতি দেখালেও তা সমগ্র চিত্র বদলে দেয়নি। বিপরীতে খাদ্য মন্ত্রণালয় সর্বোচ্চ ১৩২.৭৮ শতাংশ ব্যয় করেছে। এটি বরাদ্দের চেয়ে বেশি। তবে প্রকৃত বাস্তবায়নের সঙ্গে এ ধরনের ব্যয়ের সামঞ্জস্য নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। আইএমইডি বলছে, প্রকৃত ব্যয় ও আর্থিক প্রতিবেদনের মধ্যকার ব্যবধান ভবিষ্যতে প্রকল্প মূল্যায়নকে আরও জটিল করবে।
পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, ‘বাস্তবায়নের হার স্পষ্টতই কম। শুধু সংখ্যা নয়, কেন এমন হচ্ছে, সেটাই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।’ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সামনের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন থাকায় প্রকল্প বাস্তবায়নে আরও ধীরতা দেখা দিতে পারে। ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফিন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইএনএম) নির্বাহী পরিচালক মুস্তফা কে মুজেরী বলেন, সাধারণত অর্থবছরের শুরুতে কিছুটা ধীরতা দেখা যায়, তবে এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। নির্বাচনকালীন প্রশাসন সাধারণত ঝুঁকিনির্ভর হয় না, ফলে প্রকল্পের গতি আরও কমতে পারে।
সব মিলিয়ে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, প্রশাসনিক দ্বিধা এবং মাঠপর্যায়ের নিয়ন্ত্রণহীনতার কারণে এডিপি বাস্তবায়ন যে পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে, তা দিয়ে নির্ধারিত লক্ষ্য অর্জন কঠিন। চলতি অর্থবছরে এডিপির বরাদ্দ ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু প্রথম পাঁচ মাসে যে গতি দেখা গেছে, তাতে বছরের শেষে কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি অর্জন করা সহজ হবে না।

