অনলাইনে রিটার্ন জমা বাধ্যতামূলক করা, অনলাইন ভ্যাট রিফান্ড মডিউল চালু করা এবং অন্যান্য অটোমেশন উদ্যোগ নেওয়ায় জাতীয় রাজস্ব ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন শুরু হয়েছে। ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা এ পরিবর্তনকে স্বস্তির সূচনা হিসেবে দেখছেন।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) জানিয়েছে, ভ্যাট ও শুল্ক খাত আরও ডিজিটাল করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর ফলে কর ফাঁকি রোধ হবে এবং গ্রাহক হয়রানি কমবে। ২০২৫-২৬ অর্থবছরে এখন পর্যন্ত ২০ লাখের বেশি করদাতা অনলাইনে ই-রিটার্ন জমা দিয়েছেন। গত আগস্টে, পাঁচ ধরনের করদাতা ব্যতীত, সব করদাতার জন্য অনলাইনে আয়কর রিটার্ন জমা বাধ্যতামূলক করা হয়। দেশে বর্তমানে ১ কোটি ১২ লাখ কর শনাক্তকরণ নম্বরধারী (টিআইএন) আছেন। এর মধ্যে প্রতি বছর মাত্র ৪০ লাখ টিআইএনধারী রিটার্ন দাখিল করেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অনলাইনে রিটার্ন বাধ্যতামূলক হওয়ায় এ বছর রিটার্ন জমা দাখিলের সংখ্যা বাড়বে। গত বছর নির্দিষ্ট এলাকার ব্যক্তি করদাতা, সারাদেশের ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও কিছু বহুজাতিক কোম্পানির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য অনলাইনে রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক করা হয়। তখন ১৭ লাখের বেশি করদাতা অনলাইনে রিটার্ন জমা দিয়েছিলেন।
রাজস্ব সম্প্রসারণ ও কর আদায় বাড়াতে এনবিআর নতুন ১২টি কমিশনারেট, কাস্টমস হাউজ এবং বিশেষায়িত ইউনিট গঠন করেছে। এদের আওতায় কাস্টমস ও ভ্যাট অনুবিভাগে মোট ৩,৫৯৭টি নতুন পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, “পুনর্গঠনের মাধ্যমে পরোক্ষ কর আহরণের সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। কর-জিডিপি অনুপাত বাড়বে, বিনিয়োগ সম্প্রসারণ হবে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত হবে।”
এনবিআর জানিয়েছে, ভ্যাট অটোমেশনের মাধ্যমে আগামী বছরে এক লাখ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ভ্যাটের আওতায় আনা হবে। এছাড়া ভ্যাট নিবন্ধন ছাড়া ব্যবসা বা সেবা পরিচালনা করা সম্ভব হবে না। নতুন পদক্ষেপ নেওয়া হবে এবং ভ্যাটের আওতা আরও বিস্তৃত হবে। এনবিআরের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আল-আমিন শেখ বলেন, “বর্তমানে ভ্যাট নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৬ লাখ ৪৪ হাজার। ই-সহগ, ভ্যাট স্মার্ট চালান, রিস্ক-বেজড অডিট চালু করা হয়েছে। আরও এক লাখ নতুন ভ্যাট নিবন্ধনের কাজ চলছে।”
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান বলেন, “মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত করতে হলে সিস্টেম ও প্রসেস উন্নত করতে হবে। রাজস্ব আদায় সবসময়ই চ্যালেঞ্জিং। করদাতাকে হয়রানি করা হবে না, আমরা নিশ্চিত করব। পাশাপাশি কর ফাঁকি রোধে জোর দেওয়া হচ্ছে। প্রথমবার অডিট নির্দেশিকা জারি করা হয়েছে। এতে করদাতার যোগ্যতা যাচাইয়ের ব্যবস্থা আছে।”
বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেন, “অটোমেশন ছাড়া দুর্নীতি কমানো সম্ভব নয়। বন্ডসহ সব প্রক্রিয়া দ্রুত অটোমেশনে আনা প্রয়োজন।”
অডিট বা নিরীক্ষার মাধ্যমে করদাতাদের জমা কাগজপত্র ও হিসাব-নিকাশ যাচাই করা হয়। আগে একাধিকবার একই করদাতাকে হয়রানি করার অভিযোগ থাকত। এখন ঝুঁকিভিত্তিক পদ্ধতিতে রিটার্ন বাছাই করা হবে। শতভাগ অটোমেশন এখনও চালু নয়, তবে ধাপে ধাপে সম্পূর্ণ অটোমেশন কার্যকর হবে।
গত ১০ নভেম্বর এনবিআর অনলাইনে ভ্যাট রিফান্ড মডিউল চালু করেছে। এখন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান কাঁচামাল বা সেবা কেনার সময় দেওয়া ইনপুট ভ্যাটের অতিরিক্ত অংশ রিফান্ড হিসেবে দাবি করতে পারবে। আগের মতো রিফান্ডের জন্য দীর্ঘ অপেক্ষা থাকবে না। এছাড়া এনবিআর বন্ড অটোমেশন, বাংলাদেশ সিঙ্গেল উইন্ডো, গ্রিন চ্যানেল, আংশিক রপ্তানিকারকদের বন্ড সুবিধা, বন্ডেড পণ্যের এইচএস কোড মিল না থাকলেও দ্রুত খালাস ব্যবস্থা এবং কাস্টমস বন্ড ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম চালু করেছে।
অর্থনীতিবিদ ড. মাহফুজ কবীর বলেন, “অটোমেশনের কারণে রাজস্ব ব্যবস্থাপনা উন্নতি পাবে। তবে সার্বিক অর্থনৈতিক পরিবেশও উন্নত হতে হবে।” চলতি অর্থবছরের (২০২৫-২৬) প্রথম চার মাসে (জুলাই–অক্টোবর) ১ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায় হয়েছে। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৪.২ শতাংশ বৃদ্ধি। বছরের শুরুতে ৪ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। ২৪ নভেম্বর এই লক্ষ্যমাত্রা ৫৪ হাজার কোটি টাকা বাড়িয়ে ৫ লাখ ৫৪ হাজার কোটি টাকা করা হয়েছে। এর আগে দেশের ইতিহাসে মধ্যবর্তী সময়ে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো হয়নি।
ড. মাহফুজ কবীর বলেন, “এ ধরনের সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক সরকারের নেওয়া উচিত। বছরের মাঝপথে পরিবর্তন ব্যবসায়ীদের জন্য অসুবিধা সৃষ্টি করতে পারে। তাই এর যুক্তিসঙ্গততা মূল্যায়নের দাবি রাখে।”

