ব্রিটিশ ভারতের সময় ১৮৫৩ সালে প্রতিষ্ঠিত টেলিগ্রাফ ব্রাঞ্চের উত্তরসূরি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশনস কোম্পানি লিমিটেড বা বিটিসিএল। একাধিক কাঠামোগত পরিবর্তনের পর ২০০৮ সালে এটি রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি হিসেবে যাত্রা শুরু করে। তবে যাত্রার পরের ১৪ বছর প্রতিষ্ঠানটি টানা লোকসানে ছিল। বিপুল সম্পদ থাকা সত্ত্বেও সেগুলোর সঠিক রেকর্ড না থাকায় বিটিসিএলের আর্থিক স্বচ্ছতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন উঠেছে। পাশাপাশি বিভিন্ন প্রকল্প ও কার্যক্রমে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগও রয়েছে। এসব সত্ত্বেও সংস্কারের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটিকে লাভজনক করার ক্ষেত্রে সরকারের কার্যকর উদ্যোগ চোখে পড়ছে না।
বিটিসিএলের আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০২৪-২৫ অর্থবছর শেষে কোম্পানিটির মোট সম্পদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬৭ হাজার ৩৩৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৫৭ হাজার ৯৮৩ কোটি টাকার স্থায়ী সম্পদের কোনো লিখিত বিবরণ নেই। ফলে এসব সম্পদের বাস্তব অস্তিত্ব ও সঠিক মূল্য যাচাই করা সম্ভব হয়নি বলে জানিয়েছে নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান আনিস সালাম ইদ্রিস অ্যান্ড কোম্পানি চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস।
মন্দ ঋণের বিপরীতে বিটিসিএল ২ হাজার ১৬৩ কোটি টাকার সঞ্চিতি সংরক্ষণ করেছে। এর মধ্যে স্থানীয় অপারেটরদের কাছে পাওনা ৩৮ কোটি টাকা। স্থানীয় গ্রাহকদের কাছে ৭৭২ কোটি। বিদেশি অপারেটরদের কাছে ১ হাজার ১৮৮ কোটি এবং বন্ধ হয়ে যাওয়া কোম্পানির কাছে ১৬৫ কোটি টাকা। তবে এসব পাওনার বিস্তারিত তালিকা ও সহায়ক নথি কোম্পানি কর্তৃপক্ষ নিরীক্ষককে দিতে পারেনি। ফলে পাওনার যথার্থতা, বর্তমান অবস্থা এবং আদায়যোগ্যতা যাচাই করা যায়নি। এ ছাড়া স্থানীয় গ্রাহক, বিদেশি অপারেটর এবং বিদেশি পরিচালন কার্যক্রম খাতে আরও ২ হাজার ২০২ কোটি টাকার পাওনার তথ্যও দিতে ব্যর্থ হয়েছে বিটিসিএল।
বিভিন্ন ব্যাংকে থাকা বিটিসিএলের ৫৩২ কোটি টাকার নগদ অর্থের ক্ষেত্রেও একই চিত্র দেখা গেছে। ব্যাংক শাখাভিত্তিক তথ্য, হিসাবভিত্তিক বিবরণ এবং ব্যাংক স্টেটমেন্ট সরবরাহ না করায় এসব অর্থের অস্তিত্ব ও যথার্থতা যাচাই করা সম্ভব হয়নি বলে নিরীক্ষক মতামত দিয়েছেন।
নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানটির ম্যানেজিং পার্টনার মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, বিটিসিএলের জমি, টাওয়ার, জেলা পর্যায়ের কার্যালয় ও নানা ধরনের সরঞ্জাম রয়েছে। অনেক সম্পদ সরেজমিনে পরিদর্শন করা হলেও কোনো রেজিস্টার পাওয়া যায়নি। ফলে এসব সম্পদ কখন কেনা হয়েছে বা কীভাবে হিসাবের সঙ্গে মিলবে তা নির্ধারণ করা যাচ্ছে না। রেকর্ড না থাকায় যথাযথভাবে অবচয় হিসাব করাও সম্ভব হচ্ছে না। একই কারণে পাওনার বিপরীতে রাখা সঞ্চিতি রাইট অফ করা যাচ্ছে না।
তিনি আরও বলেন, সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ব্যবসার কাঠামো সংস্কার করা জরুরি। কিন্তু সরকারি প্রতিষ্ঠান হওয়ায় বিটিসিএলের ক্ষেত্রে সে উদ্যোগ দেখা যায় না। ল্যান্ডফোন অনেক আগেই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। অথচ এটিই ছিল বিটিসিএলের মূল ব্যবসা। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান হলে অনেক আগেই ব্যবসার মডেল বদলে যেত। অবকাঠামো ও সম্পদ থাকা সত্ত্বেও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবসা বৈচিত্র্যে যায় না। এটিই মূল সমস্যা।
২০০৬-০৭ থেকে ২০২০-২১ অর্থবছর পর্যন্ত বিটিসিএল টানা নিট লোকসানে ছিল। ২০২১-২২ অর্থবছর থেকে নিট মুনাফায় ফিরলেও পরিচালন লোকসান কাটেনি। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে কোম্পানিটির আয় হয়েছে ৮৯৯ কোটি টাকা। আগের বছর ছিল ৭৭৫ কোটি। তবে ব্যয় বাদ দিয়ে এ বছরও ৩২ কোটি টাকার পরিচালন লোকসান হয়েছে।
চলতি বছরের জুন শেষে বিভিন্ন ব্যাংকে বিটিসিএলের আমানত ছিল ১ হাজার ৯২২ কোটি টাকা। এ আমানত থেকে সুদ আয় হয়েছে ২৪৬ কোটি টাকা। পরিচালন লোকসান থাকলেও এই সুদ আয়ের কারণেই ২০২৪-২৫ অর্থবছরে কর-পরবর্তী ৭৬ কোটি টাকার নিট মুনাফা দেখাতে পেরেছে প্রতিষ্ঠানটি।
বিটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মামুনুর রশীদ বলেন, পাওনা অর্থ সংক্রান্ত নথি রয়েছে। ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের আওতাধীন সরকারি দপ্তরগুলোর সঙ্গে দেনা-পাওনার গরমিল নিরসনে একটি কমিটি কাজ করছে। তিনি জানান, আগের অর্থবছরের তুলনায় এ বছর অপারেটিং রেভিনিউ বেড়েছে প্রায় ১২৪ কোটি টাকা। পরিচালন লোকসানও কমে ১০০ কোটি টাকা হ্রাস পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৩২ কোটিতে। এই অগ্রগতি আগামী অর্থবছরে অপারেটিং ব্রেক-ইভেন অর্জনের বিষয়ে আশাবাদী করছে বলে জানান তিনি।
স্থায়ী সম্পদের বিষয়ে তিনি বলেন, সম্পদের পরিসর বড় হওয়ায় ম্যানুয়াল রেজিস্টার রাখা সম্ভব নয়। তাই বিভিন্ন অফিসভিত্তিক সফট কপিতে তথ্য সংরক্ষণ করা হচ্ছে। এতে অস্বচ্ছতার সুযোগ নেই বলে দাবি করেন তিনি। সম্পদ ব্যবস্থাপনা আরও আধুনিক করতে ইআরপি সফটওয়্যারের ফিক্সড অ্যাসেট মডিউল কেনার প্রক্রিয়া চলছে বলেও জানান।
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় বিটিসিএলের ফাইভজি রেডিনেস প্রকল্পটি ব্যাপক আলোচনায় আসে। প্রায় ৩২৬ কোটি টাকার এ প্রকল্পে ঠিকাদার নিয়োগ নিয়ে সাবেক মন্ত্রী ও সচিবের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত শেষে গত বছরের ডিসেম্বরে জমা দেওয়া প্রতিবেদনে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সাবেক এক সচিবের বিরুদ্ধে সরাসরি অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রতিবেদনে অনিয়মের মাত্রাকে গুরুতর ও নজিরবিহীন বলা হয়। অতীতেও বিটিসিএলের বিভিন্ন কাজে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে।
এ বিষয়ে এমডি মো. মামুনুর রশীদ বলেন, সব প্রকল্প সরকারি বিধিবিধান অনুযায়ী পরিচালিত হয়। দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত করে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তিনি দাবি করেন, বিটিসিএলকে আধুনিক ও লাভজনক করতে সব সেবা ডিজিটাল করা হয়েছে। প্রতিযোগিতামূলক বাজারে প্রতিষ্ঠানটিকে টিকিয়ে রাখতে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের গঠিত সংস্কার কমিটিও কাজ করছে।
অর্থ বিভাগ গত বছরের ডিসেম্বরে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ ও আর্থিক ঝুঁকি নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে ২০২২-২৩ অর্থবছরের তথ্য ব্যবহার করা হয়। প্রতিবেদনে দেখা যায়, সরবরাহকারীদের অর্থ পরিশোধে বিটিসিএলের সময় লাগে গড়ে ২ হাজার ৬১১ দিন। এটিকে সরকারের জন্য উচ্চ ঝুঁকি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ঋণ পরিশোধের সক্ষমতার দিক থেকেও প্রতিষ্ঠানটি ঝুঁকিপূর্ণ। ২০২৫ সালের জুন শেষে বিটিসিএলের দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৯৯৫ কোটি টাকায়।
ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সচিব ও বিটিসিএলের চেয়ারম্যান আব্দুন নাসের খান বলেন, বিটিসিএল সংস্কারে সরকার আন্তরিকভাবে কাজ করছে। এ লক্ষ্যে একটি সংস্কার কমিটি গঠন করা হয়েছে। শিগগিরই আধুনিকায়ন ও লাভজনক করার বিষয়ে সুপারিশ পাওয়া যাবে বলে আশা করছেন তিনি।
সম্পদ সংরক্ষণ প্রসঙ্গে চেয়ারম্যান বলেন, জেলা প্রশাসকদের সহায়তায় বিটিসিএলের জমি উদ্ধার ও অরক্ষিত জমি সুরক্ষার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি কীভাবে সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা যায় সে বিষয়েও কাজ চলছে। এ লক্ষ্যে একাধিক নতুন প্রকল্প পরিকল্পনা জমা দেওয়া হয়েছে।

