সরকারি খাতের ৪২টি প্রতিষ্ঠান আর্থিকভাবে উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয় বিভিন্ন আর্থিক অনুপাতের মানদণ্ড ব্যবহার করে এই ঝুঁকি মূল্যায়ন করেছে। দেশে বর্তমানে ২৩৫টি স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান আছে। তবে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান সেবামূলক হওয়ায়, আর্থিক কাজে পরিচালিত ১০১টি রাষ্ট্রায়ত্ত ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার দেনা ও সম্ভাব্য দায় বিবরণী বিশ্লেষণ করে এই তথ্য উঠে এসেছে। সম্প্রতি প্রকাশিত বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা (২০২৫) এ এমন তথ্য প্রকাশিত হয়েছে।
রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক ঝুঁকি নির্ধারণে তাদের অবস্থানকে পাঁচটি স্তরে ভাগ করা হয়েছে। মূল্যায়ন অনুযায়ী ১৪টি প্রতিষ্ঠান অত্যন্ত উচ্চ ঝুঁকিতে, ২৮টি উচ্চ ঝুঁকিতে, ৩৭টি মধ্যম ঝুঁকিতে, ২০টি কম ঝুঁকিতে এবং মাত্র দুটি প্রতিষ্ঠান অত্যন্ত কম ঝুঁকিতে রয়েছে।
স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানগুলো কার্যক্রম পরিচালনা পর্ষদ বা গভর্নিং বডির মাধ্যমে চালায়। আইনগতভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় এরা প্রশাসনিকভাবে তুলনামূলকভাবে স্বায়ত্তশাসন ভোগ করে। সরকার এদের অনুদান প্রদানের মাধ্যমে অর্থায়ন করে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে পরিচালন খাতে ১৭৪টি প্রতিষ্ঠানকে ১৬ হাজার ৭১২ কোটি টাকা এবং উন্নয়ন খাতে ৬২টি প্রতিষ্ঠানকে ৩৮ হাজার ৫০২ কোটি টাকা অনুদান দেওয়া হয়েছে।
সমীক্ষায় বলা হয়েছে, বাজেটের ৬.৯২ শতাংশ এবং জিডিপির ০.৯৮ শতাংশ এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে অনুদান দেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠানগুলো জনসেবা, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, গবেষণা, সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রম তত্ত্বাবধান, নিয়ন্ত্রণ ও বাস্তবায়ন, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। তবে নিজস্ব আয়ের অপ্রতুলতার কারণে সরকারের ওপর নির্ভরশীলতা ক্রমশ বাড়ছে। অর্থ বিভাগ মনে করছে, আর্থিক ব্যবস্থাপনা উন্নত করে এবং নিজস্ব আয় বাড়িয়ে স্বনির্ভরতা অর্জন সম্ভব। অনুদান দেওয়া হলেও ২০২৩ সালের জুন শেষে এসব প্রতিষ্ঠানের দেনা প্রায় ৬ লাখ ৪০ হাজার টাকা।
স্বাধীন কার্যসম্পাদন মূল্যায়ন:
সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সুশাসন, দক্ষতা ও স্বচ্ছতা বাড়াতে অর্থ বিভাগের মনিটরিং সেল ইন্ডিপেন্ডেন্ট পারফরম্যান্স ইভালিউশন গাইডলাইন (আইপিইজি) প্রণয়ন করেছে। গত অর্থবছরে ২০ প্রতিষ্ঠান আইপিইজি অনুযায়ী মূল্যায়ন করা হয়েছে। বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের স্কোর ‘ভালো’, কিছু প্রতিষ্ঠান ‘খুব ভালো’ স্কোর পেয়েছে। তবে কোনো প্রতিষ্ঠান ‘চমৎকার’ স্কোর পায়নি।
আর্থিক স্বনির্ভরতার চ্যালেঞ্জ:
২০২৪-২৫ অর্থবছরে পরিচালন খাতে অনুদান পাওয়া ১৭৪টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৮৮টির কোনো নিজস্ব আয় নেই। ৮৬টির আয়ের সম্মিলিত পরিমাণ মাত্র ২ হাজার ৫১ কোটি টাকা। এটি প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালন ব্যয়ের মাত্র ১০.৫২ শতাংশ কভার করতে সক্ষম। অর্থ বিভাগ মনে করছে, প্রতিষ্ঠানগুলো যদি আর্থিক ব্যবস্থাপনা উন্নত করে এবং নিজস্ব আয় বাড়ায়, তাহলে সরকারের ওপর নির্ভরশীলতা কমানো সম্ভব।
শিল্প খাতের সাম্প্রতিক অবস্থা:
গত তিন অর্থবছরের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি) ইউরিয়া উৎপাদন ও বিক্রয় থেকে রাজস্ব বাড়িয়েছে। তবে বাংলাদেশ বস্ত্র শিল্প করপোরেশন (বিটিএমসি) দীর্ঘদিন উৎপাদনহীন থাকার কারণে ধারাবাহিক লোকসান বহন করছে। বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন (বিএসএফআইসি)-এর উৎপাদন ও রাজস্ব বৃদ্ধি প্রাক্কলন করা হয়েছে। বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশন (বিজেএমসি) কার্যত উৎপাদন বন্ধ থাকায় লোকসান চালিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে, বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল করপোরেশন (বিএসইসি) মোটরযান ও মোটরসাইকেল উৎপাদন উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়াবে বলে আশা করা হচ্ছে।
খেলাপি ঋণ বেড়ে ৪২৯ কোটি টাকা:
গত অর্থবছরে রাষ্ট্রায়ত্ত ৮টি প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ ৪২৯ কোটি ১০ লাখ টাকা। আগের অর্থবছরে ৯টি প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ ছিল ১৯৮ কোটি ৬১ লাখ টাকা। এক বছরের ব্যবধানে ঋণ বেড়েছে ২৩০ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। খেলাপি ঋণের তালিকায় বাংলাদেশের পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) ছাড়া অন্য ৮টি প্রতিষ্ঠানও রয়েছে।
সমীক্ষার তথ্য অনুযায়ী, জুন শেষে প্রতিষ্ঠানগুলোর মোট পুঞ্জীভূত ব্যাংক ঋণ দাঁড়িয়েছে ৪২ হাজার ৯৫৫ কোটি ৩১ লাখ টাকা, আগের বছর একই সময়ে ৩৫ হাজার ১২৩ কোটি ৮১ লাখ টাকা ছিল। ৮টির মধ্যে সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ রয়েছে ‘বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশন’-এর (বিজেএমসি), যা ৩৭৭ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। এর আগে এই ঋণ ছিল ১৩১ কোটি ৩০ লাখ টাকা। খেলাপি ঋণের তালিকায় আরও আছে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস করপোরেশন (বিটিএমসি), বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি), বাংলাদেশ চা বোর্ড (বিটিবি), বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সংস্থা (বিআরটিসি), বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি), ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) এবং বাংলাদেশ খাদ্য ও চিনি শিল্প করপোরেশন (বিএসএফআইসি)।

