সমুদ্রসীমা জয় করে এক দশক পেরিয়েছে বাংলাদেশ। তবুও বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে কোনো উল্লেখযোগ্য সাফল্য মেলেনি। প্রতিবেশী দেশ ভারত, পাকিস্তান ও মায়ানমার যেখানে সমুদ্রে জ্বালানিসম্পদ আবিষ্কারে এগিয়ে গেছে, বাংলাদেশ সেখানে দেড় দশক ধরে পিছিয়ে রয়েছে।
সর্বশেষ প্রমাণ মিলেছে সম্প্রতি আহবান করা সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের দরপত্র থেকে। সাতটি বিদেশি বহুজাতিক কোম্পানি দরপত্রের নথি কিনলেও শেষ পর্যন্ত কেউ দরপত্র জমা দেয়নি। ফলে সমুদ্রের সম্ভাব্য তেল-গ্যাস অনুসন্ধান অনিশ্চয়তায় পড়েছে।
জ্বালানি খাতের বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্ট সূত্র জানান, বহুজাতিক কোম্পানিগুলো আগ্রহ হারানোর পেছনে কয়েকটি মূল কারণ রয়েছে। এর মধ্যে আছে প্রফিট শেয়ার মার্জিন কম, জরিপ তথ্যের অভাব, কর্মীদের প্রফিট ফান্ড (ডব্লিউপিপিএফ) শেয়ারিং বাধ্যবাধকতা, ব্লকের ভূতাত্ত্বিক তথ্য সংগ্রহের উচ্চমূল্য, গভীর সমুদ্র থেকে স্থলভাগ পর্যন্ত অতিরিক্ত হুইলিং চার্জ এবং দেশের রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা। বিশেষ করে ডব্লিউপিপিএফে অর্থ পরিশোধের বাধ্যবাধকতা বহুজাতিক কোম্পানির আপত্তির প্রধান কারণ।
জ্বালানি বিভাগ ও পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা গেছে, সরকার সম্প্রতি ড্রাফট অফশোর মডেল প্রোডাকশন শেয়ারিং কন্ট্রাক্ট (পিএসসি) ২০২৫ পর্যালোচনা ও সুপারিশ দিতে একটি কমিটি গঠন করেছে। কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস কম্পানি লিমিটেডের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মহসিন। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ কমিটিকে ১৫ জানুয়ারির মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলেছে। এর আগে পেট্রোবাংলা ড্রাফট পিএসসি ২০২৫ চূড়ান্ত করে। এতে আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানিগুলোর আগ্রহ বাড়াতে গ্যাসের মূল্য নির্ধারণ, পাইপলাইন ব্যয় পুনরুদ্ধার এবং কাজের বাধ্যবাধকতায় বড় সংস্কার আনা হয়েছে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “সাতটি বিদেশি কোম্পানি দরপত্রের নথি কিনেও কেন অংশ নেয়নি তা পর্যালোচনা করা হচ্ছে। দরপত্র পুনর্বিবেচনা ও প্রস্তুতি চলছে। আগে আমরা সময়মতো কাজ করতে পারিনি, এতে এলএনজি আমদানিকারক গোষ্ঠীর ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল হয়ে গিয়েছিলাম। তবে পার্শ্ববর্তী দেশ মায়ানমার ও ভারত এগিয়ে গেছে। এখন বিদেশি কোম্পানির মতামত বিবেচনা করা প্রয়োজন।”
তিনি আরও বলেন, “দেশের স্বার্থ রক্ষা করতে হবে। একই সঙ্গে ডব্লিউপিপিএফে অর্থ জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা ও বৈদেশিক মুদ্রায় বিনিয়োগের কার্যকারিতা নিয়ে স্পষ্ট নির্দেশনা দরকার। বাপেক্সের অফশোর ড্রিলিং ক্ষমতা নেই, তাই বিদেশি কোম্পানির ওপর নির্ভর করতে হবে। অসংগতিগুলো সংশোধন জরুরি।”
বিনিয়োগের বড় বাধা:
বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ ও শ্রম বিধিমালা ২০১৫ অনুযায়ী, ডব্লিউপিপিএফে নির্দিষ্ট হারে অর্থ জমা দিতে হবে। কিন্তু বৈদেশিক মুদ্রায় বিনিয়োগকৃত প্রকল্পে এই বিধান কিভাবে কার্যকর হবে, তা স্পষ্ট নয়। কিছু বহুজাতিক কোম্পানি দাবি করে, এটি আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডব্লিউপিপিএফ শুধু শ্রমিকের কল্যাণ নিশ্চিত করে না, শিল্প খাতেও টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি আনে। সঠিক নীতিমালা ও স্বচ্ছ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ডব্লিউপিপিএফ তহবিল উৎপাদনমুখী খাতে বিনিয়োগ করা গেলে শ্রমিকদের আর্থিক নিরাপত্তা বাড়বে, কর্মীদের প্রেরণা বৃদ্ধি পাবে এবং শিল্প প্রতিষ্ঠানের দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা নিশ্চিত হবে।
বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. ইজাজ হোসেন বলেন, “পেট্রোবাংলা প্রাথমিকভাবে সব সমস্যা চিহ্নিত ও সমাধানের চেষ্টা করেছে। তবে দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে বহুজাতিক কোম্পানি দরপত্র জমা দিতে আগ্রহ দেখায়নি। প্রধান কারণ ছিল উচ্চ আর্থিক ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তা।”
তিনি আরও বলেন, “রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে এলে আবার দরপত্র আহবান করা হবে। সাম্প্রতিক সংশোধনে গ্যাসের দাম আন্তর্জাতিক তেলের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে, যা বিনিয়োগকারীদের জন্য আকর্ষণীয়। কাঠামোগত ছোটখাটো সমস্যা সমাধান হলে ভবিষ্যতে ভালো বিনিয়োগ সম্ভাবনা রয়েছে।”
নতুন পিএসসি, তবুও সাড়া নেই:
পেট্রোবাংলা পিএসসি ২০২৩ প্রণয়ন করে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে। এতে গ্যাসের দাম ব্রেন্ট ক্রুড তেলের ১০ শতাংশ হিসেবে ধরা হয়। তেলের দাম বাড়লে গ্যাসের দাম বাড়বে। সরকারের অংশীদারির হারও কমানো হয়। মার্কিন এক্সনমবিল, শেভরন, মালয়েশিয়ার পেট্রোনাস, জাপানের ইনপেক্স ও জোগম্যাক, চীনের সিনুক, ভারতের ওএনজিসি সহ একাধিক বড় কোম্পানি পেট্রোবাংলার সঙ্গে যোগাযোগ ও সমুদ্র জরিপের তথ্য কিনে। তবুও কেউ দরপত্রে অংশ নেয়নি। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে কেউ আগ্রহ দেখায়নি।
পেট্রোবাংলার পিএসসি পরিচালক প্রকৌশলী মো. শোয়েব জানান, “বিদেশি কোম্পানির আগ্রহ বাড়াতে পিএসসি ২০২৫-এ কিছু সংশোধনী আনা হচ্ছে। ব্রেন্ট ক্রুডের ১০ শতাংশ ধরা হলেও এবার সাড়ে ১০ শতাংশ ধরা হবে। এতে বহুজাতিক কোম্পানি ভালো সাড়া দিতে পারে।”
বহুজাতিক কোম্পানির প্রতিক্রিয়া:
বাংলাদেশ অংশে গভীর সমুদ্রে ১৫টি এবং অগভীর সমুদ্রে ১১টি ব্লক রয়েছে, মোট ২৬টি। ২০১০ সালে কনোকোফিলিপস দুটি গভীর সমুদ্র ব্লকে কাজ শুরু করলেও গ্যাসের দাম বাড়ানোর দাবি পূরণ না হওয়ায় সরে যায়। অস্ট্রেলিয়ার সান্তোস ও দক্ষিণ কোরিয়ার পস্কো দাইয়ু চুক্তি বাতিল করে চলে যায়। ২০১৯ সালে ভারতের ওএনজিসি একটি কূপ খনন করে, কিন্তু গ্যাসের সন্ধান না পেয়ে দ্বিতীয় কূপ খনন না করেই কাজ শেষ করে।
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ, ব্লকের তথ্য মূল্য ও হুইলিং চার্জ নীতিগতভাবে সমাধান করা সম্ভব। তবে ডব্লিউপিপিএফ ও শ্রম আইনের অস্পষ্টতা দূর করতে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগ জরুরি। সংশোধিত শ্রম আইন অনুযায়ী নতুন ও সুস্পষ্ট বিধিমালা প্রণয়ন প্রয়োজন।

