বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলগুলোর গড় চিনি আহরণের হার মাত্র ৬ শতাংশ অর্থাৎ দেশের আখ থেকে গড়ে প্রতি ১০০ কেজি আখে মাত্র ছয় কেজি চিনি উৎপন্ন হয়—এ তথ্য প্রকাশ পেয়েছে এসব চিনিকলের বার্ষিক আর্থিক বিবরণীতে।
তুলনায়, ব্রাজিলের মতো বড় রপ্তানিকারক দেশে আখ তুলনামূলকভাবে মোটা ও রসসমৃদ্ধ। ব্রাজিলে চিনি আহরণের হার ১৪ শতাংশ, অস্ট্রেলিয়ায় ১২ শতাংশ এবং ভারতে ৯ থেকে ১০.৫ শতাংশের মধ্যে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের অধিকাংশ রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকল এখনও পাঁচ দশকেরও বেশি পুরোনো যন্ত্রপাতি ব্যবহার করছে। এর বড় অংশের উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানও বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
অতিরিক্ত বিনিয়োগ ও নতুন যন্ত্রপাতি সংযোজন করা হলেও রাষ্ট্রায়ত্ত মিলগুলোর উৎপাদন ব্যয় বেসরকারি কাঁচা চিনি আমদানিকারক রিফাইনারির তুলনায় এখনও অনেক বেশি। দীর্ঘমেয়াদে এই মিলগুলোর টেকসইতা নিয়েও বারবার সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছে।
সরকার প্রতিবছর শত শত কোটি টাকা খরচ করেই এসব জরাজীর্ণ মিল চালিয়ে রাখে। সর্বশেষ উদাহরণ, গত সেপ্টেম্বর মাসে আখ কেনার জন্য ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দের পর চলতি অর্থবছরে কৃষকদের পাওনা পরিশোধ এবং বাড়তে থাকা ‘ট্রেড গ্যাপ’ মেটাতে শিল্প মন্ত্রণালয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে আরও ৩৭৯ কোটি টাকা চেয়েছে।
নথি অনুযায়ী, বর্তমানে চালু থাকা নয়টি রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলের মধ্যে আটটিই বছরে গড়ে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা লোকসান করছে। জরাজীর্ণ কারখানাগুলোতে প্রতি কেজি চিনি উৎপাদন ব্যয় প্রায় ৩০০ টাকা, যা বিক্রয়মূল্যের তুলনায় অনেক বেশি। কাঁচামাল, পরিচালন ব্যয় এবং কর্মীদের বেতন পরিশোধের যোগ্য আয়ও হয় না। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে চার হাজার কোটিরও বেশি টাকার অনাদায়ী ঋণ। ফলে প্রতিটি মিলের গড় বার্ষিক লোকসান দাঁড়াচ্ছে প্রায় ৫০ কোটি টাকা।
সাবেক অর্থসচিব মাহবুব হোসেন বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলগুলো বন্ধ করা উচিত। তিনি বলেন, “কর্মসংস্থানের অজুহাতে লোকসান দিয়ে মিলগুলো চালানো অর্থনৈতিকভাবে অযৌক্তিক।” তিনি আরও বলেন, অন্য দেশে যেখানে আখভিত্তিক চিনি উৎপাদন আধুনিকায়ন করা হয়েছে বা এ খাত থেকে সরে এসেছে, সেখানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত মিলগুলো প্রযুক্তিগত উন্নয়নও করতে পারেনি।
মিলগুলোর মালিকানায় থাকা বিপুল জমি অন্য খাতে বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে পারে এবং অনেক বেশি অর্থনৈতিক সুফল দিতে পারে। বিশ্ববাজারে চিনি উদ্বৃত্ত থাকায় বাংলাদেশ সহজেই চিনি আমদানি করতে পারবে। সরকারও এখন স্বীকার করছে, মিলগুলো বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান ৬ ডিসেম্বর বলেন, “শুধু ভর্তুকি দিয়ে চিনিকল চালানো সম্ভব নয়।” তিনি জানান, সম্ভাব্য স্থানীয় ও বিদেশি বিনিয়োগকারীর সঙ্গে আলোচনা চলছে। অল্প সময়ের মধ্যে অগ্রগতি আশা করা যাচ্ছে। দেশের উৎপাদিত চিনি শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমদানি স্থগিত রাখা হবে।
৩৭৯ কোটি টাকার ঘাটতি:
শিল্প মন্ত্রণালয় অর্থ মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের মাড়াই মৌসুমের আখের মূল্য পরিশোধ ও ছাড়করণের জন্য ৩৭৯.৬৯ কোটি টাকা মঞ্জুরির প্রস্তাব জানিয়ে। চিঠিতে বলা হয়েছে, চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশনের (বিএসএফআইসি) ‘ট্রেড গ্যাপ’ এবং ভর্তুকি বাবদ পাওনা এখন ৮ হাজার ১৩০ কোটি টাকা।
বিএসএফআইসি সচিব মোহাম্মদ মুজিবুর রহমান বলেন, সরকার নির্ধারিত দামে চিনি বিক্রি করতে বাধ্য থাকায় উৎপাদন ব্যয় অনেক বেশি হলেও মিলগুলো ক্ষতির মুখে পড়ছে। তিনি বলেন, “উৎপাদন ব্যয়ের নিচে চিনি বিক্রি হওয়ায় ট্রেড গ্যাপ তৈরি হয়, যা সরকার প্রতিবছর ভর্তুকি দিয়ে পূরণ করে।”
সচিব আরও বলেন, “মিলগুলো সচল রাখতে নতুন বিনিয়োগ অত্যন্ত জরুরি। মেশিনারিজ অনেক পুরাতন। এমনকি কিছু মিলের যন্ত্রপাতি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানেরই আর অস্তিত্ব নেই। তাই নিজস্ব কারখানায় মেরামত করে সচল রাখা হচ্ছে। পুরনো মেশিনারিজের কারণে চিনি আহরণের পরিমাণও কম।”
আসন্ন ২০২৫-২৬ মাড়াই মৌসুমের সর্বশেষ ফলন জরিপ অনুযায়ী, আটটি চিনিকলে মোট ৭.৬৭ লাখ মেট্রিক টন আখ মাড়াই করা যাবে। সেপ্টেম্বর মাসে ছাড় করা ১০০ কোটি টাকা এই প্রয়োজনের মাত্র ২০.৮৫ শতাংশ মেটাতে সক্ষম হয়েছে। ফলে ৩৭৯ কোটি টাকার ঘাটতি রয়ে গেছে।
চিনি আহরণ হার মাত্র ৬ শতাংশে আটকা:
রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ চিনি আহরণ হার সাধারণত জিল বাংলা সুগার মিলের। অভ্যন্তরীণ নথি অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মিলটির আহরণ হার ছিল ৬.৩৮ শতাংশ। তবে দেশের অন্যান্য মিলের সঙ্গে মিলিয়ে সামগ্রিক আহরণ হার প্রায় ৬ শতাংশের কাছাকাছি রয়েছে। জিল বাংলার ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বিক্রয় তথ্য অনুযায়ী, উৎপাদিত ১,৯২৯ টন চিনির বড় অংশ সরকারকে সরবরাহ করা হয়েছে। এর মধ্যে ১,৩১১ টন পুলিশ বাহিনীতে এবং ২৯২ টন প্রতিরক্ষা বাহিনীতে বিতরণ করা হয়েছে।
শুধুমাত্র কেরু অ্যান্ড কোম্পানি মুনাফায়:
বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশনের (বিএসএফআইসি) আওতায় ১৫টি চিনিকল ও চিনি কলের পাশাপাশি একটি যন্ত্রপাতি মেরামতের কোম্পানি রয়েছে। লোকসান কমানোর জন্য ২০২০ সালে সরকার ছয়টি চিনিকল বন্ধ করে দেয়। বর্তমানে চালু থাকা নয়টির মধ্যে আটটিই এখনও লোকসানে রয়েছে।
চুয়াডাঙ্গার দর্শনায় অবস্থিত কেরু অ্যান্ড কোম্পানি (বাংলাদেশ) লিমিটেড একমাত্র মিল যা মুনাফা করছে। মিলটির চিনি ইউনিটে বড় লোকসান হলেও ডিস্টিলারি ইউনিটে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রায় ১৯০ কোটি টাকা মুনাফা হয়েছে। একই সময়ে চিনি ইউনিটে লোকসান হয়েছে প্রায় ৬২ কোটি টাকা।
অন্য মিলগুলো ২০২৪-২৫ অর্থবছরের আয়-ব্যয়ের হিসাব এখনও প্রকাশ করেনি, কারণ আর্থিক নিরীক্ষা চলমান রয়েছে। তবে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের নিরীক্ষিত হিসাব অনুযায়ী, আটটি মিলের সম্মিলিত লোকসান ছিল ৪২২ কোটি টাকা। একই সময়ে মোট পুঞ্জীভূত লোকসান দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা এবং মোট দায় ৪ হাজার ৭২ কোটি টাকা।
গড়ে ৫০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে সংগ্রামে মিলগুলো:
মিলগুলোর ২০২৩-২৪ অর্থবছরের আর্থিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, প্রতিটি মিলে গড়ে ৫০০ কোটি টাকা ঋণ রয়েছে। এই ঋণের বড় অংশ এসেছে সরকারি মালিকানাধীন সোনালী ব্যাংক থেকে। এছাড়া মিলগুলোর প্যারেন্ট প্রতিষ্ঠান—বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশন (বিএসএফআইসি) থেকেও ঋণ রয়েছে।
পরিচালনা ব্যয় এবং কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধে মিলগুলো ব্যাপকভাবে ঋণ নিয়েছে। কিন্তু রাজস্ব আয় না হওয়ার কারণে ঋণ পরিশোধ সম্ভব হচ্ছে না। ফলে প্রতিবছর ঋণের দায় বাড়ছে। আর্থিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলসের ঋণ সবচেয়ে বেশি—৭৮৬ কোটি টাকা, যার মধ্যে কৃষিঋণ ৫১৭ কোটি টাকা।
চালু মিলগুলোর মধ্যে জিল বাংলা সুগার মিলস ২০২৪-২৫ অর্থবছরের পূর্ণাঙ্গ আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে দেখা গেছে, মিলটির চিনির উৎপাদন বেড়েছে এবং আয় দাঁড়িয়েছে ৪৭.৩২ কোটি টাকায়, যা আগের বছর ছিল ৪৪.৬৩ কোটি টাকা। পুঞ্জীভূত লোকসান এখন ৭০৪ কোটি টাকা।
জিল বাংলার ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. তারিকুল আলম জানিয়েছেন, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মিলটি ৭২ হাজার টন আখ মাড়াই করে ৬.৩৮ শতাংশ আহরণ হারে ৪,৫৯৯ টন চিনি উৎপাদন করেছে। তিনি বলেন, “চিনি উৎপাদন হলেও সব চিনি বিক্রি করতে পারিনি। স্টকে রাখা হয়েছে। সরকার যখন বিক্রির অনুমতি দেবেন, তখন বিক্রি শুরু হবে। এক বছর আগে ৪৪,৯৮৮ মেট্রিক টন আখ মাড়াই করে ২,৭১৭ মেট্রিক টন চিনি উৎপাদন হয়েছিল। তখন আহরণের হার ছিল ৬.০৮ শতাংশ।”

