দেশে প্রতিদিন গ্যাসের চাহিদা বাড়ছে, কিন্তু দেশীয় উৎপাদন কমছে। এই পরিস্থিতিতে সরকারের পরিকল্পনা হলো আমদানি করা এলএনজির ওপর নির্ভরতা বাড়ানো। বড় কোনো নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত না হলে আপাতত এলএনজি ছাড়া বিকল্প নেই।
সরকার তাই তৃতীয় গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। ‘মহেশখালী/মাতারবাড়ী-বাখরাবাদ তৃতীয় সমান্তরাল গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন নির্মাণ’ শীর্ষক প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই শেষ হয়েছে। প্রাথমিক উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবও প্রস্তুত। জিটিসিএল (গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেড) প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে। পেট্রোবাংলা ও জিটিসিএলের কর্মকর্তারা বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা বলেন, যেহেতু প্রকল্পটি জিটিসিএলের দায়িত্বে, তাই বিস্তারিত জানতে জিটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. হারুণ ভূঁইয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছিল। তবে একাধিকবার ফোন করেও তার কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
জানা গেছে, এই গ্যাস পাইপলাইনের মোট প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ২৪ হাজার ৩২০ কোটি টাকা। কাজ শুরু হবে ২০২৬ সালের জুলাইয়ে এবং শেষ হবে ২০৩১ সালের জুনে। অর্থাৎ প্রকল্প বাস্তবায়নে পাঁচ বছর লাগবে।
বর্তমানে মহেশখালীতে দুটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল (এফএসআরইউ) থেকে প্রতিদিন ১১০০ মিলিয়ন ঘনফুট আরএলএনজি সরবরাহ করা হয়। ভবিষ্যতে আরও ১৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট যোগ হবে—৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট কুতুবজোমে নতুন ভাসমান টার্মিনাল থেকে এবং ১০০০ মিলিয়ন ঘনফুট মাতারবাড়ীতে স্থলভিত্তিক টার্মিনাল থেকে। ফলে মহেশখালী ও মাতারবাড়ী থেকে মোট ২৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করতে হবে। বিদ্যমান পাইপলাইনের মাধ্যমে এত গ্যাস পরিবহন সম্ভব নয়।
এই কারণে আন্তর্জাতিক পরামর্শক সংস্থা ক্যাললগ ব্রাউন অ্যান্ড রুট এশিয়া প্যাসিফিক প্রাইভেট লিমিটেডের মাধ্যমে বিস্তারিত সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করা হয়েছে। সমীক্ষা অনুযায়ী, মহেশখালী সিটিএমএস থেকে কুমিল্লার বাখরাবাদ পর্যন্ত ৪৬ ইঞ্চি ব্যাসের ৩২৬ কিলোমিটার পাইপলাইন নির্মাণ করা হবে। মাতারবাড়ী থেকে উত্তর নলবিলা ভাল্ব স্টেশন পর্যন্ত ৪০ ইঞ্চি ব্যাসের আরও ৯ কিলোমিটার পাইপলাইন লাগবে। যদিও প্রকল্পটি জিটিসিএলের, প্রতিষ্ঠানটির নিজস্ব অর্থায়নে এটি বাস্তবায়নের সক্ষমতা নেই। এজন্য বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাইকা, আইডিএসহ আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নেওয়ার প্রস্তাব রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, এই পাইপলাইনের ওপরই নির্ভর করছে এলএনজি আমদানি বৃদ্ধির সক্ষমতা। বর্তমানে দুটি এফএসআরইউ দিয়ে ১১০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস আমদানি হলেও পাইপলাইনের সীমাবদ্ধতায় সর্বোচ্চ ১৪০০ মিলিয়ন ঘনফুট আমদানি করা সম্ভব।
অন্যদিকে, দেশীয় উৎপাদন দিন দিন কমছে। এক সময় দেশে প্রতিদিন ২৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়া গেলেও ২০ ডিসেম্বর তা নেমে আসে ১৭৪৮ মিলিয়নে। দেশের সবচেয়ে বড় গ্যাসক্ষেত্র বিবিয়ানার মজুতও দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। আগে বিবিয়ানায় দৈনিক ১৩৫০ মিলিয়ন ঘনফুট উৎপাদন হতো, এখন তা নেমে এসেছে মাত্র ৮৫৫ মিলিয়নে।
পেট্রোবাংলার অনেক কর্মকর্তা আশঙ্কা করছেন, ২০২৬ সালের শেষ নাগাদ বিবিয়ানার দৈনিক উৎপাদন ৫০০ মিলিয়নের নিচে নেমে যেতে পারে। এ পরিস্থিতিতে দেশীয় উৎপাদন দেড় হাজার মিলিয়নেরও নিচে নামতে পারে।
এমন পরিস্থিতিতে মাতারবাড়ী ও মহেশখালীতে নতুন টার্মিনাল স্থাপন জরুরি হয়ে পড়েছে। দরপত্র প্রক্রিয়ার খসড়া প্রস্তুত আছে। সরকার জিটুজি ভিত্তিতে প্রকল্প বাস্তবায়নের কথাও ভাবছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানান, উন্মুক্ত দরপত্রে এক বছর লাগবে চূড়ান্ত করতে, এরপর টার্মিনাল বসাতে দুই বছর লাগবে। জিটুজি করলে সময় বাঁচবে। এ বিষয়ে সৌদি আরব, কাতার, আজারবাইজানসহ চারটি দেশ আগ্রহ দেখিয়েছে। এখন আলোচনা চলছে—কে সবচেয়ে কম খরচে এবং কম সময়ে টার্মিনাল স্থাপন করতে পারবে।
বর্তমানে দেশে দুটি এফএসআরইউ চালু আছে—একটি সামিট গ্রুপ পরিচালনা করে, অন্যটি যুক্তরাষ্ট্রের এক্সিলারেট। তৃতীয় টার্মিনালের জন্য পূর্ববর্তী সরকার সামিটের সঙ্গে সরাসরি চুক্তি করেছিল, তবে নিরাপত্তা জামানত না দেওয়ায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তা বাতিল করেছে। সামিট গ্রুপ আদালতের দ্বারস্থ হয়েছে। জটিলতা এড়াতে মহেশখালীর কুতুবজোমে প্রস্তাবিত টার্মিনালকে ‘চতুর্থ টার্মিনাল’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান ২১ অক্টোবর এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘প্রতি বছর দেশীয় গ্যাস উৎপাদন গড়ে ২০০ মিলিয়ন করে কমছে। চেষ্টা করেও আমরা উৎপাদন ধরে রাখতে পারছি না। ঘাটতি পূরণে এলএনজি আমদানি করছি, যা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। এছাড়া আমদানির অবকাঠামোও এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।’

