অন্তর্বর্তী সরকার শ্রমিকদের বকেয়া বেতন ও ভাতা পরিশোধের জন্য দেওয়া ৭০০ কোটি টাকারও বেশি সুদমুক্ত ঋণ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ফেরত না দেওয়ায় বেক্সিমকো গ্রুপসহ অন্তত ১০টি সমস্যাগ্রস্ত শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিকদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে যেসব কারখানার মালিক ঋণ ফেরত দেবে না, তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে। পাশাপাশি মালিক, ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও পরিচালকদের বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হবে এবং পাসপোর্ট জব্দ করারও নির্দেশ রয়েছে। এরপরও টাকা না ফেরালে প্রতিষ্ঠানগুলোর জমি, কারখানা ও যন্ত্রপাতি বিক্রি করে ঋণ আদায়ের পরিকল্পনা রয়েছে। গত ৮ ডিসেম্বর বেক্সিমকো ইন্ডাষ্ট্রিয়াল পার্কের শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর শ্রম ও ব্যবসা পরিস্থিতি পর্যালোচনা-সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটির বৈঠকের কার্যবিবরণী থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
অফিশিয়াল নথি অনুযায়ী, গত বছরের ৫ আগস্টের পর বিভিন্ন শিল্পকারখানায় বেতন বকেয়া পড়ায় শ্রমিকরা আন্দোলনে নামে। শ্রম অসন্তোষ নিরসনের জন্য শ্রম মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে অর্থ বিভাগ ও কেন্দ্রীয় তহবিল থেকে ১০টি প্রতিষ্ঠানকে ৬ মাসের মধ্যে ফেরত দেওয়ার শর্তে ৭০১.৬ কোটি টাকা সুদমুক্ত ঋণ দেওয়া হয়। এর মধ্যে শ্রম মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া হয়েছে ৭৬ কোটি ১৪ লাখ ৫৫ হাজার ১১৫ টাকা এবং অর্থ বিভাগ থেকে ৬২৫ কোটি ৪৬ লাখ টাকা।
ঋণ ফেরতের বিষয় নিশ্চিত করতে শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন একাধিকবার কারখানার মালিক ও বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। বৈঠকে সরকারের অর্থ ফেরত দেওয়ার বিষয়ে সহযোগিতা চাওয়া হয়।
সংকটে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলো: ঋণ গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে:
- বেক্সিমকো গ্রুপ
- বার্ডস গ্রুপ
- টিএনজেড গ্রুপ
- ইয়েলো অ্যাপারেলস লিমিটেড
- ডার্ড গ্রুপ
- নায়াগ্রা টেক্সটাইলস লিমিটেড
- রোয়ার ফ্যাশন লিমিটেড
- মাহমুদ জিন্স লিমিটেড
- অ্যাপারেল চেইন বিডি লিমিটেড
সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছে বেক্সিমকো গ্রুপ। শ্রমিকদের বকেয়া মজুরি পরিশোধের জন্য সরকার দুই দফায় প্রায় ৫৮৫ কোটি টাকা সুদমুক্ত ঋণ দিয়েছে। প্রথম দফা ঋণ দেওয়া হয়েছিল গত বছরের নভেম্বরে ৫৯.৫৩ কোটি টাকা এবং দ্বিতীয় দফা চলতি বছরের ৬ মার্চ ৫২৫.৪৬ কোটি টাকা। নির্ধারিত পরিশোধের সময়কাল শেষ হলেও এখনো ঋণ ফেরত দেয়নি।
বার্ডস গ্রুপকে ২০২৪ সালের ১১ নভেম্বর ১৯ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছিল। নির্ধারিত সময় ২০২৫ সালের ১১ মে শেষ হলেও কোনো অর্থ ফেরত দেননি। টিএনজেড গ্রুপ দুই দফায় মোট ২৮ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। এর মধ্যে ১৬ কোটি টাকা দেওয়া হয় গত বছরের ২৮ নভেম্বর এবং ১২ কোটি চলতি বছরের ২৮ মে। নির্ধারিত সময় পার হওয়া সত্ত্বেও তারা অর্থ ফেরত দেয়নি।
অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ইয়েলো অ্যাপারেলসকে ৩৭.৩২ কোটি, ডার্ড গ্রুপকে ১৩ কোটি, নায়াগ্রা টেক্সটাইলকে ১৮ কোটি, রোয়ার ফ্যাশনকে ১.২৩ কোটি, মাহমুদ জিন্সকে ২১ কোটি এবং অ্যাপারেল চেইনকে ১ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। নির্ধারিত সময় পেরিয়ে গেলেও কোনো প্রতিষ্ঠানই অর্থ ফেরত দেয়নি। অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, মূলত শ্রমিক অসন্তোষ রোধের লক্ষ্যেই এই ঋণগুলো দেওয়া হয়েছিল। তবে অনেক কারখানা বন্ধ থাকায় অর্থ আদায়ের পরিকল্পনা সফল হয়নি।
নতুন শ্রমিক অসন্তোষের আশঙ্কা:
বর্তমানে বিএইচআইএস অ্যাপারেলস, সিজনস ড্রেসেস ও প্যারাডাইস কেবলস বেতন-ভাতা দিতে পারছে না। বকেয়া বেতন-ভাতা যথাক্রমে ২.২৭ কোটি, ১৬.৭৫ কোটি ও ৮.৪০ কোটি টাকা।
৮ ডিসেম্বরের সভায় প্যারাডাইস ক্যাবলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোবারক হোসেন জানান, ২০১৭ সাল থেকে কারখানাটি বন্ধ। আগামী তিন মাসের মধ্যে বকেয়া পরিশোধের চেষ্টা চলছে। সিজনস ড্রেসেস কেন্দ্রীয় শ্রম তহবিল থেকে সুদমুক্ত ঋণের আবেদন করেছে। বিএইচআইএস অ্যাপারেলসের কোনো প্রতিনিধি সভায় উপস্থিত ছিলেন না। ডার্ড গ্রুপের প্রতিনিধি বলেন, প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ করতে না পারায় শ্রমিকদের বকেয়া দিতে পারছেন না।
এ পরিস্থিতিতে শ্রম উপদেষ্টা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের একটি কারিগরি কমিটি গঠন করেছেন। কমিটি ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের বকেয়া পরিশোধ এবং নতুন অস্থিরতা এড়াতে পূর্ণাঙ্গ কর্মপরিকল্পনা তৈরি করবে।

