আবাসন খাত বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি। মানুষের মৌলিক চাহিদা বাসস্থানের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত এই খাত। তবে বর্তমানে নানা সংকটে জর্জরিত আবাসন খাত। একই সঙ্গে এর ভেতরেই রয়ে গেছে ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা।
খাতসংশ্লিষ্টদের মতে, আবাসন খাতের সবচেয়ে বড় সংকট জমির উচ্চমূল্য ও নির্মাণ ব্যয়ের লাগামছাড়া বৃদ্ধি। রড, সিমেন্ট, বালি ও অন্যান্য নির্মাণসামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়ায় ফ্ল্যাটের মূল্য সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদহার এবং ঋণপ্রাপ্তির জটিলতা। ফলে আগ্রহ থাকলেও অনেক ক্রেতা সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না।
নগর পরিকল্পনার অসংগতি, ড্যাপসংক্রান্ত জটিলতা, নকশা অনুমোদনে দীর্ঘসূত্রতা এবং নীতিগত অনিশ্চয়তাও নির্মাতাদের জন্য বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব কারণে নতুন প্রকল্প নিতে অনেক ডেভেলপার পিছিয়ে যাচ্ছেন।
তবে সংকটের মাঝেই সম্ভাবনার কথাও বলছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। দেশে নগরায়ণ বাড়ছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে বাড়ছে পরিকল্পিত আবাসনের চাহিদা। মধ্যবিত্ত ও স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য ছোট আয়তনের ফ্ল্যাট, সহজ কিস্তি সুবিধা এবং দীর্ঘমেয়াদি হোম লোন আবাসন বাজারকে আবার সচল করতে পারে। প্রযুক্তির ব্যবহার, পরিবেশবান্ধব নির্মাণ এবং পরিকল্পিত স্যাটেলাইট শহর গড়ে তোলার উদ্যোগ এই খাতকে নতুন ভিত্তি দিতে পারে বলে মনে করছেন তারা।
খাতসংশ্লিষ্টদের মতে, রিহ্যাব ফেয়ারের মতো আয়োজন আবাসন খাতের সমস্যা ও সম্ভাবনার মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করছে। গত বুধবার ঢাকার চীনমৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে শুরু হয়েছে রিহ্যাব ফেয়ার। এক ছাদের নিচে ক্রেতা ও নির্মাতাদের সরাসরি যোগাযোগের সুযোগ তৈরি হওয়ায় আস্থা বাড়ছে, কমছে ভুল বোঝাবুঝি। সঠিক নীতিসহায়তা, সহজ ঋণব্যবস্থা ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা থাকলে আবাসন খাত ঘুরে দাঁড়াবে এবং অর্থনীতিতে নতুন গতি আনবে বলে প্রত্যাশা মেলায় অংশ নেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর।
হেরিটেজ রিয়েল এস্টেট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মির্জা মুক্তাদির বলেন, রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক না থাকায় আবাসন খাতের ব্যবসা মন্দা যাচ্ছে। এবারের আবাসন মেলাতেও মানুষের উপস্থিতি কম। গতবারের তুলনায় ভালো যায়নি এবারের মেলা।
হক হোমস অ্যান্ড বিল্ডার্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ইমদাদুল হক বলেন, ব্যবসা-বাণিজ্যের বর্তমান অবস্থা আবাসন মেলাতেই স্পষ্ট। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে আশা করা যায়। তার মতে, আবাসন খাতের ব্যবসা এখন তুলনামূলকভাবে খারাপ। তিনি বলেন, নির্মাণসামগ্রীর দাম বৃদ্ধি, ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদ এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ফ্ল্যাট ও প্লট বিক্রি কমেছে। দাম বাড়ায় মধ্যবিত্তদের জন্য ফ্ল্যাট কেনা এখন কঠিন হয়ে পড়েছে।
রিয়েল এস্টেট অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ থেকে ২০১২ সালে বছরে প্রায় ১৫ হাজার ফ্ল্যাট বিক্রি হতো। কিন্তু ২০২২-২৩ সালে তা কমে ১০ হাজারের নিচে নেমে আসে। প্রতিবছর আবাসন কোম্পানিগুলো ১৫ থেকে ২০ হাজার ফ্ল্যাট নির্মাণ করে বিক্রি করতে পারে। তবে চাহিদার তুলনায় বেশি ফ্ল্যাট নির্মাণ হলে একটি বড় অংশ অবিক্রিত থাকে। এতে নির্মাণ কার্যক্রম কমিয়ে দিতে হয়। এর পেছনে উচ্চ রেজিস্ট্রেশন ব্যয়, ব্যাংক ঋণের সুদহার বৃদ্ধি, নকশা অনুমোদনের জটিলতা এবং দুদক ও এনবিআর-সংক্রান্ত ভীতি কাজ করছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুনে গ্রামীণ এলাকায় আবাসন ঋণের গ্রাহক ছিলেন ৪৬ হাজার ৩০ জন। তাদের ঋণের পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা। সেপ্টেম্বর শেষে গ্রাহকসংখ্যা কমে দাঁড়ায় ৪৪ হাজার ৭৪৩ জনে এবং ঋণের পরিমাণ নেমে আসে ৩ হাজার ৭০৮ কোটি টাকায়।
শহর এলাকায় জুনে আবাসন ঋণের গ্রাহক ছিলেন ৯৩ হাজার ৮৭৮ জন। ঋণের পরিমাণ ছিল ৩১ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা। সেপ্টেম্বরে গ্রাহকসংখ্যা কিছুটা কমে ৯৩ হাজার ৩৮১ জন হলেও ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৩১ হাজার ৬৬৫ কোটি টাকায়। ২০২৫ সালের জুন শেষে ভোক্তা ঋণ বছরওয়ারি বেড়েছে ২৬ শতাংশ। এর মধ্যে আবাসন ঋণে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩৮ শতাংশ, যা সবচেয়ে বেশি। বর্তমানে প্রচলিত নীতিমালা অনুযায়ী ব্যাংক থেকে সর্বোচ্চ দুই কোটি টাকা পর্যন্ত আবাসন ঋণ নেওয়ার সুযোগ রয়েছে।
ড্যাপ গেজেট প্রকাশের পর ২০২২ সালের ২৩ আগস্ট থেকে ফ্ল্যাট ব্যবসায় বড় ধরনের ধস নামে। গেজেটে ভবনের উচ্চতা কমিয়ে দেওয়ায় ডেভেলপাররা আগের মতো ফ্ল্যাট নির্মাণ করতে পারেননি। ফলে ফ্ল্যাটের সংখ্যা কমে যায় এবং নির্মাণ ব্যয় বেড়ে যায়। ব্যবসা কমে যাওয়ায় অনেক আবাসন কোম্পানি নতুন করে নকশা অনুমোদনের আবেদন বন্ধ করে দেয়।
আবাসন ব্যবসায়ীরা জানান, আগে ৫ কাঠা জমিতে ৯ তলা ভবন নির্মাণ করা যেত। এতে ভবন মালিক ও ডেভেলপার উভয়ই ৮টি করে ফ্ল্যাট পেতেন। কিন্তু ২০২২ সালে ড্যাপ গেজেট প্রকাশের পর ভবনের উচ্চতা ৪ থেকে ৫ তলায় নেমে আসে। এতে ডেভেলপারের ফ্ল্যাট সংখ্যা কমে যায়। বাড়তি নির্মাণ ব্যয় তুলতে না পারায় বিনিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। ফলে নতুন ফ্ল্যাট নির্মাণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়।
এই প্রেক্ষাপটে ঢাকার কিছু এলাকায় ভবনের আয়তন ও ফ্ল্যাট সংখ্যা বাড়ানোর সুযোগ দিতে সরকার ড্যাপ সংশোধন করেছে। গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় চলতি বছরের ১৪ ডিসেম্বর সংশোধিত ড্যাপের প্রজ্ঞাপন জারি করে। এটি ড্যাপের দ্বিতীয় সংশোধন। পাশাপাশি ঢাকা মহানগর ইমারত নির্মাণ বিধিমালা-২০২৫ এর প্রজ্ঞাপনও জারি হয়েছে। এতদিন ২০০৮ সালের বিধিমালা অনুযায়ী নির্মাণকাজ চলছিল।
ঢাকা মহানগরসহ আশপাশের এক হাজার ৫২৮ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে ২০২২ থেকে ২০৩৫ সালের জন্য এই মহাপরিকল্পনা করা হয়েছে। ২০৩৫ সাল পর্যন্ত ঢাকার নগর উন্নয়ন কার্যক্রম এই দলিল অনুসরণ করেই পরিচালিত হবে।
সংশোধিত ড্যাপ অনুযায়ী, আওতাধীন এলাকার কৃষিজমিতে স্থায়ী স্থাপনা নির্মাণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবে অনুমোদন সাপেক্ষে কৃষিজমিতে পোলট্রি, গবাদিপশুর খাবার ও ফিশারির জন্য অস্থায়ী অবকাঠামো নির্মাণ করা যাবে। আগে কৃষিজমিতে মুদি দোকান, ফার্মেসি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণের সুযোগ ছিল। এখন সেসব অনুমোদন আর থাকছে না।
রিহ্যাবের সিনিয়র ভাইস-প্রেসিডেন্ট লিয়াকত আলী ভূঁইয়া বলেন, ড্যাপ ইতোমধ্যে সংশোধন হয়েছে। ফলে সামনে আবাসন খাতে ব্যবসা ভালো হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। রাজনৈতিক সংকটের কারণে বর্তমানে ব্যবসা মন্দা থাকলেও শিগগিরই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।

