‘যার মধ্যে সৌন্দর্য, সজীবতা, জীবনীশক্তি ও উদ্দীপনা থাকে সেই তরুণ। তারুণ্যকে কখনও সময়ের সাথে বা নির্দিষ্ট কোন বয়সসীমায় বেঁধে রেখে বর্ণনা করা যায় না৷ তারুণ্য একটি অভিজ্ঞতা বা নির্ভরতা, যা বিভিন্নভাবে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণ অনুযায়ী চিহ্নিত করা যেতে পারে’৷
বাংলাদেশে তরুণ জনগণের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে৷ ২০২৪ সালের মধ্যে দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩৫ শতাংশ তরুণ, যারা কর্মক্ষম বয়সে পৌঁছেছে। শ্রমজীবী তরুণদের জন্য এই সময়টি একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, যেহেতু তাদের ভবিষ্যৎ শুধুমাত্র তাদের ব্যক্তিগত জীবন নয়, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
বাংলাদেশের শ্রমবাজারে তরুণদের জন্য চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনার মিশ্রণ রয়েছে। বর্তমানে, নির্মাণ, পোশাক শিল্প, এবং সেবা খাতে বড় ধরনের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে। বিশেষ করে গার্মেন্টস শিল্পের বিকাশ তরুণদের জন্য অনেক সুযোগ তৈরি করেছে। তবে, চাকরির বাজারে একটি বড় সমস্যা হচ্ছে অযোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার অভাব। অনেক তরুণ উচ্চশিক্ষা লাভ করলেও তাদের প্রয়োজনীয় দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতা নেই, যার ফলে তারা প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকতে পারছে না।
শিক্ষা ব্যবস্থা এবং প্রশিক্ষণ কর্মসূচি শ্রমজীবী তরুণদের দক্ষতা উন্নয়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। কিন্তু, বর্তমান শিক্ষা পদ্ধতি প্রায়শই তাত্ত্বিক জ্ঞানে সীমাবদ্ধ এবং কার্যকরী দক্ষতার ওপর কম গুরুত্ব দেয়। দক্ষতার ভিত্তিতে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের অভাব তরুণদের কর্মসংস্থানে চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করছে। এ ছাড়া, প্রযুক্তি এবং প্রশিক্ষণের সঠিক সমন্বয়ের অভাবে অনেক তরুণ আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে অদক্ষ রয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশে শ্রম আইন ও কর্মস্থলে নিরাপত্তা বিষয়ক সমস্যা রয়েছে। অনেক তরুণ শ্রমিক কম মজুরি, দীর্ঘ কাজের সময় এবং কর্মস্থলে নিরাপত্তাহীনতার শিকার হচ্ছেন। আইনগত রক্ষণাৱেক্ষণ ও বাস্তবায়নের অভাবে শ্রমিকদের অধিকারের সুরক্ষা ত্রুটিপূর্ণ। শ্রম আইন ও কর্মস্থলে নিরাপত্তা সংক্রান্ত ব্যাবস্থা শক্তিশালী করতে হবে। শ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষা ও স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করার জন্য কার্যকরী আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিৎ।
বর্তমান যুগে প্রযুক্তির বিকাশ তরুণদের জন্য নতুন সুযোগ ও চ্যালেঞ্জ উন্মোচন করেছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI), রোবটিক্স এবং অটোমেশনের উদ্ভাবন তরুণদের কাজের ধরনে পরিবর্তন আনছে। উদাহরণস্বরূপ, গ্রাহক সেবা এবং উৎপাদন খাতে অটোমেশন আগের তুলনায় অনেক বেশি কার্যকরী হয়ে উঠছে, যা কিছু প্রচলিত চাকরি হুমকির মুখে ফেলছে। তবে, নতুন প্রযুক্তির চাহিদা মেটাতে তরুণদের প্রযুক্তিগত দক্ষতা বাড়ানোর প্রয়োজন।
উদ্যোক্তা সংস্কৃতি বাংলাদেশের তরুণদের জন্য নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। নতুন ব্যবসার সম্ভাবনা এবং সরকারের উদ্যোক্তা সহায়তা কর্মসূচি তরুণদের মধ্যে উদ্যোক্তা মানসিকতা গড়ে তুলছে। স্টার্টআপ কোম্পানিগুলোর বিকাশ এবং বিনিয়োগের সুযোগ তরুণদের জন্য কর্মসংস্থানের নতুন রাস্তা খুলে দিয়েছে। এই উদ্যমকে সমর্থন দেওয়ার জন্য সঠিক পরামর্শ, প্রশিক্ষণ এবং অর্থায়নের ব্যবস্থা প্রয়োজন।
সরকার তরুণদের জন্য বিভিন্ন প্রকল্প ও নীতির মাধ্যমে সহায়তা প্রদানে সক্রিয়। যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের বিভিন্ন কর্মসূচি, যেমন কর্মসংস্থান সৃষ্টি, প্রশিক্ষণ এবং প্রযুক্তি শিক্ষা তরুণদের ভবিষ্যৎ উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তবে, এই প্রকল্পগুলির কার্যকারিতা বাড়ানোর জন্য আরও সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের প্রয়োজন৷
বাংলাদেশে শ্রমজীবী তরুণদের জন্য অনেক সামাজিক ও অর্থনৈতিক বাধা রয়েছে। নিম্ন আয়ের পরিবার থেকে আগত তরুণদের জন্য শিক্ষার সুযোগ সীমিত, যা তাদের কর্মসংস্থানে প্রভাব ফেলছে। এছাড়া, স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্যা ও জীবনযাত্রার উচ্চ ব্যয়ও তরুণদের কর্মক্ষমতা প্রভাবিত করছে।
বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিবর্তন বাংলাদেশের শ্রমবাজারে প্রভাব ফেলছে। আন্তর্জাতিক বাজারের ওঠানামা এবং বৈশ্বিক মন্দা বাংলাদেশের শ্রমবাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে। বিদেশী বিনিয়োগ ও রফতানি আয়ের ওপর নির্ভরশীলতার কারণে, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিবর্তন শ্রমজীবী তরুণদের জন্য অনিশ্চয়তা তৈরি করছে।
বর্তমান বৈচিত্র্যময় শ্রমশক্তির মধ্যে, তরুণদের জন্য সামগ্রিক সমন্বয়ের অভাব একটি বড় চ্যালেঞ্জ। বিভিন্ন শিল্পে ভিন্ন ভিন্ন দক্ষতা ও প্রয়োজনীয়তার কারণে, শ্রমবাজারে তরুণদের জন্য সঠিক কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে উঠছে।
শিক্ষা ব্যবস্থা এবং প্রশিক্ষণ কর্মসূচির মান বৃদ্ধি করতে হবে। প্রযুক্তিগত দক্ষতা উন্নয়ন এবং আধুনিক শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে, যাতে তরুণরা কর্মবাজারের চাহিদার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হয়।
উদ্যোক্তাদের জন্য আরো সহায়তা, পরামর্শ ও অর্থায়নের ব্যবস্থা করা উচিত। তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষ সহায়তা কেন্দ্র ও কর্মশালা আয়োজন করলে উদ্যোক্তা সংস্কৃতির বিকাশ ঘটবে।
শ্রম আইন এবং কর্মস্থলে নিরাপত্তা সংক্রান্ত ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে হবে। শ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষা এবং স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করার জন্য কার্যকরী আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।
বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিবর্তনের সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য সরকারের উচিত আন্তর্জাতিক বাজারের পরিবর্তন অনুযায়ী প্রণয়িত নীতি ও পরিকল্পনা গ্রহণ করা।
বাংলাদেশের শ্রমজীবী তরুণদের ভবিষ্যৎ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাদের দক্ষতা, প্রশিক্ষণ, এবং প্রযুক্তিগত সক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে দেশের উন্নয়ন অগ্রগতি হবে। তাই, সরকারের উচিত কর্মসংস্থান সৃষ্টি, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রক্রিয়া উন্নত করা এবং শ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষা নিশ্চিত করা। তরুণদের সমন্বিতভাবে সহায়তা প্রদান করে, আমরা একটি উন্নত এবং সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে সক্ষম হবো।